সুন্দরবনের যৌথ সংবাদ সম্মেলন

পৃথিবীর এক প্রাচীনতম ও সুন্দরতর বনভূমি জ্বলে-পুড়ে ছাই হচ্ছে
পৃথিবীর এক প্রাচীনতম ও সুন্দরতর বনভূমি জ্বলে-পুড়ে ছাই হচ্ছে

[মধ্য বঙ্গোপসাগর থেকে এক বিদেশি জাহাজের কাপ্তেন তাঁর সহকর্মীকে বললেন, দেখো দেখো, বাংলাদেশের পতাকার মতো গাঢ় সবুজ বোটল গ্রিন—বনভূমি থেকে আগুনের লাল লেলিহান শিখা। পৃথিবীর এক প্রাচীনতম ও সুন্দরতর বনভূমি জ্বলে-পুড়ে ছাই হচ্ছে। এ যেন অভিনব দাবানল। দূর থেকে দেখে নাবিকের মনে হলো যেন একটি জনপদ বা দেশ জ্বলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলে বহু বছর যাবৎ তিনি যাতায়াত করছেন, কিন্তু এমন দাবানল কোথাও তাঁর চোখে পড়েনি। চোখে দুরবিন লাগিয়ে তিনি আরও দেখতে পেলেন বনের ডোরাকাটা বাঘ, চিতল হরিণ, মস্ত অজগর প্রভৃতি প্রাণী দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক। তারা বাঁচতে চায় আগুনের হল্কা থেকে। এই সব বাঘ-হরিণ নিজেদের চোখে দেখা তো দূরের কথা, তাদের বাপের জনমেও এমন ভয়াবহ ও সুপরিকল্পিত আগুনের কথা শোনেনি।
বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রায়ই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে গোলটেবিল ও মতবিনিময় হয় প্রতিদিন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতারা তাঁদের সমস্যা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। সুন্দরবন নিয়েও গত কয়েক বছরে বহুবার সংবাদ সম্মেলন, গোলটেবিল ও মানববন্ধন করা হয়েছে। হয়েছে সুন্দরবন অভিমুখে মানুষের পদযাত্রা। তাতে অংশগ্রহণকারীদের পিঠে, পাঁজরে ও ঊরুতে পড়েছে পুলিশের লাঠির পরশ। কোনো কাজ হয়নি। এবার বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বৃক্ষেরা তাদের এলাকার জীবজন্তু ও জলজ প্রাণীদের নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতো অজ্ঞাত স্থানে অনুষ্ঠিত সেই প্রেস কনফারেন্সে পঠিত পেপারটি আমাদের হাতে এসেছে। যৌথ সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজক ছিল সুন্দরবনের বৃক্ষ এবং বাঘ, হরিণ, কুমির, ডলফিন প্রভৃতি। বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত তাদের বক্তব্যটি দীর্ঘ ছিল। কারণ, তাতে বহু বেদনার করুণ কাহিনির বর্ণনা ছিল। অত দীর্ঘ বক্তব্যের পুরোটা সম্পাদক ছাপতে সম্মত হবেন না। তাই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষ নিচে দেওয়া হলো।]

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন। আমি সব বৃক্ষ-লতাগুল্মের পক্ষ থেকে সুন্দরী বলছি। আমার বাঁ দিকে আছে হরিণ ও বাঘ। এই বাঘ মহাশয়ের বয়স ৪৪ বছরের মতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর খানেক পরেই তার জন্ম। আধুনিক বাংলাদেশের অনেক ঘটনার সে সাক্ষী। তার বাঘিনী পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর ভাষ্যমতে পার্শ্ববর্তী দেশে বেড়াতে গেছে। আর ফিরে আসেনি। এরও দাঁতটাত সব পড়ে গেছে। মৃত্যুর দিন গুনছে। কাউকে কামড়ানোর শক্তি নেই। আপনারা ভয় পাবেন না। পাখিদের সংবাদ সম্মেলনে আনিনি। ওদের মধু সংগ্রহকারীদের সম্পর্কে যেসব অপবাদ দেওয়া হয়, সে প্রসঙ্গ উঠলে ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিকদের পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে।
সুন্দরবনের ইতিহাস আপনারা জানেন। লাখ বছর আগে বিধাতা এটি নিজের হাতে বানিয়েছেন। মানুষ চীনের প্রাচীর বানাতে পারে, তাজমহল বানাতে পারে, ষাটগম্বুজ মসজিদ বানাতে পারে, কান্তজিউ মন্দির বানাতে পারে, আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করতে পারে, পদ্মা নদীর ওপর দীর্ঘতম ব্রিজ বানানোও সম্ভব, কিন্তু সুন্দরবন বা আমাজন অরণ্য বানাতে পারে না। আমাজন বা সুন্দরবন বানাতে সময় লাগে হাজার হাজার বছর, কিন্তু তা বিধ্বংসের জন্য ১৫ থেকে ২৫ বছরই যথেষ্ট। কখনো তার চেয়েও কম সময়।
২০ হাজার বছর আগের কথা ছেড়ে দিই। ঈসা নবীর জন্মের ৫০০ বছর আগে মহামতি বুদ্ধের সময় থেকে আড়াই হাজার বছরে উপমহাদেশে কত নরপতি গত হয়েছেন। তাঁরা কেউ আমাদের গায়ে হাত দেননি। মগধের রাজবংশের বিম্বিসার থেকে একালের বঙ্গবন্ধু, মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর থেকে সেদিনের জিয়াউর রহমানসহ কত রকম শাসক আমরা দেখেছি। ধরণির এক কোণে আমরা আমাদের মতোই নিরুপদ্রবে ছিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ মাথায় পড়ল বজ্রাঘাত। কোনো এক অপদেবতার কুনজরে পড়লাম আমরা—সুন্দরবনের উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণিকুল।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা
আপনারা জেনে থাকবেন, সুন্দরবন নিজেই একটি সাম্রাজ্য। যেমন ছিল তুরস্কের বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য বা মোঙ্গলীয় শাসক চেঙ্গিস খাঁর রাজত্ব। এযাবৎকাল পর্যন্ত মানুষের বা রাজনৈতিক দলের শাসনের আমাদের প্রয়োজন হয়নি। সুন্দরবন সাম্রাজ্যে আমরা হাজার বছর ধরে একটি সর্বপ্রজাতির কোয়ালিশন সরকার চালাচ্ছিলাম। কোনো দলবাজি বা দলীয় রাজনীতি আমাদের মধ্যে ছিল না। আমাদের নেই কোনো সুন্দরী লীগ, গেওয়া জাতীয়তাবাদী দল, কেওড়া উলেমা লীগ, আমরা সম্পূর্ণ সাম্যবাদী নীতিতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের নেই কোনো সিপিএম বা কমিউনিস্ট পার্টি অব সুন্দরবনস বা সুন্দরবনের কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের সর্বদলীয় কোয়ালিশন সরকারের রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রধানমন্ত্রী, কুমির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, হরিণ সংস্কৃতিমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী করি পক্ষিকুলের কাউকে, মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ডলফিনের। শত শত বছরে বৈদেশিক আক্রমণ না হওয়ায় আমরা কোনো সেনাবাহিনী রাখিনি। আমাদের পানিসীমা পাহারা দেওয়ার জন্য কুমিররাই যথেষ্ট।
আপনারাই খবর দিয়েছেন আমাদের পূর্বাংশে গত এক মাসে চারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। প্রায় একই জায়গায় ২৭ মার্চ, ১৩ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এপ্রিলের শেষ হপ্তায় আবার দেখা যায় চাঁদপাই রেঞ্জের নাগলি ক্যাম্প এলাকায় আগুনের লেলিহান শিখা। এসব আগুন আপনাআপনি জ্বলে উঠেছে, তা ললিপপ চোষা চার বছরের কম বয়স্ক শিশু ছাড়া আর কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমাদের কাছে যা সবচেয়ে বিস্ময়কর বা বেদনাদায়ক বলে বোধ হয়েছে তা হলো কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কিছুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যায়নি।
পরিবেশ ও আমাদের–বিষয়ক এক মাননীয় মন্ত্রী বিদেশের কোথাও থেকে ঘুরে এসে সাংবাদিকদের বলেছেন, এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য মৌয়ালরা দায়ী। তিনি যদি সব জেনেশুনে বলে থাকেন সেটা খুব ভালো কথা। দ্রুত অপরাধী চিহ্নিত হবে। অনুমাননির্ভর কথা অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর। মৌয়ালরা আগুনের ধোঁয়া দিয়ে মৌচাকের মধু সংগ্রহ করেন, তাঁরা আমাত্য ও আমলাদের মতো আগুন নিয়ে খেলেন না। মৌলবাদী আর মৌয়াল শব্দে অনুপ্রাস থাকলেও তারা এক জিনিস নয়। মৌলবাদীরা ধর্ম থেকে মধু বাদ দিয়ে বিষ সংগ্রহ করে, আর মৌয়ালরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে তাঁরা বিক্রি করে সংসার চালান। বউ-বাচ্চাদের জন্য চাল-ডাল-নুন-তেল কেনেন। জীবিকার জায়গায় কেউ আগুন লাগায় না।
আমাদের শরীরে আগুন লাগানোর ঘটনায় রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও তাঁর পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে আদালতে আমলা করেছেন বনবাবুরা। নাগলি ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ দুই বোটম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বন বিভাগ। ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তাঁরা নাকি ১০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন। আপনাদের মনুষ্য সমাজে ‘তদন্ত কমিটি’ বলে যে জিনিসটির কথা শোনা যায়, তা এক অতি হাস্যকর বস্তু। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত যত তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তা সময়ক্ষেপণ করে মানুষকে স্রেফ সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পর দোষী শাস্তি পেয়েছে, এমন ঘটনা বিরল। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনা হোক বা সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে হোক, যত ভালো রিপোর্টই দেওয়া হোক, তা চাপা পড়ে থাকবে, তাতে সুন্দরবনের কোনো কোনো কচ্ছপ বা জংলি ছাগলেরও সন্দেহ নেই।

প্রিয় মিডিয়া বন্ধুগণ,
আমরা সুন্দরবনবাসী বুঝে গেছি আপনাদের বাঙালিদের সবুজ বনভূমির চেয়ে মেঠো জমি বেশি পছন্দ। তাই আপনাদের স্বজাতি কাউকে যখন একটি দেশলাই নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখি তখন আমাদের বুক কাঁপে। আগে আমরা করাত ও কুঠার হাতে কোনো আদম সন্তানকে দেখলে ভয়ে কাঁপতাম। এখন কারও হাতে একটি দেশলাই ও কোনো তরল পদার্থভর্তি জেরিকেন দেখলে শিউরে উঠি। বুঝতে পারি আমাদের জল্লাদ আমাদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে।
কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার গুঁড়া ও গরম পানির তাপ আমাদের নাকের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে গিয়ে জমা হয়ে মরতে আমাদের ২৪-২৫ বছরের মতো লাগতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি যে হারে আগুন লাগছে, তাতে প্রতি মাসে যদি তিনটি করে আগুন লাগানো হয়, পাঁচ বছরেই বৃক্ষবিহীন প্রান্তরে পরিণত হবে সুন্দরবন।
বাংলাদেশ যখন উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে, তখন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সুন্দরবনের কোনো স্টেডিয়ামেই হতে পারবে। তা যদি নাও হয়, এই সুন্দরবনের কোনো মাঠেই ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ বা ফুটবল টুর্নামেন্ট হতে আর বেশি দেরি নেই। আগুনে এভাবে পুড়তে থাকলে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে সুন্দরবনে এশিয়ার বৃহত্তম সুপার মার্কেট, বিমানবন্দর বা স্টেডিয়াম নির্মাণ করা মোটেই অসম্ভব নয়।
যারা মানুষ মারে, তাদের আপনারা জঙ্গি বলেন। যারা জঙ্গলের তাজা গাছপালা পুড়িয়ে মারে, তাদের জংলি বলা যায়। তারা আইএস জঙ্গিদের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। সব আগুনের শিখা দেখা যায় না। সব আগুনের শিখা লেলিহান হয় না। যেমন তুষের আগুন। সুন্দরবনের খুব সামান্য অংশই পুড়েছে। কিন্তু তুষের আগুন জ্বলছে সমগ্র সুন্দরবনের বুকে। কোনো জাতি প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগতের সবার অভিসম্পাত নিয়ে টিকে থাকতে পারে না, উন্নতি করা তো দূরের কথা।
ধন্যবাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।