বাঁশখালীতে জোরজুলুম কেন?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

গত ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় চারজন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। এক মাস পার হলেও সরকারি প্রশাসন এর কোনো কূলকিনারা করার বা দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করেনি। এ ব্যাপারে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। সেদিনের ঘটনা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। কারা নিহত হয়েছিলেন তাঁদের নামও হয়তো দেশবাসী জানে না। কেননা, খুব কম সংবাদমাধ্যমেই তাঁদের কথা এসেছিল। সবার অবগতির জন্য এখানে নিহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় অন্তত জানিয়ে রাখি। এঁরা হলেন মুর্তজা আলী (৬২) বর্গাচাষি ও লবণচাষি, জাকের আহমেদ (৬০) দিনমজুর, আনোয়ারুল ইসলাম আঙুর (৫৫) লবণচাষি ও চিংড়িচাষি এবং জাকের হোসেন (৩৭) লবণচাষি।
এই মর্মান্তিক ঘটনার কয়েক দিন পর এলাকাবাসীর আহ্বানে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালসহ আমি এবং তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির চট্টগ্রাম শাখা ও ঢাকার নেতারা সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি, নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যদের কথা শুনেছি। এর আগে–পরেও বেশ কয়েকজন গবেষক, নৃবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, শিক্ষক ও সাংবাদিক এলাকা পরিদর্শন করেছেন। (এ বিষয়ে তাঁদের কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সর্বজনকথা মে সংখ্যা জার্নালে)।
বিভিন্ন পত্রিকায় ‘দুই পক্ষের সংঘর্ষে’ চারজন নিহত হয়েছেন বলা হলেও আমরা প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে কোনো সংঘর্ষের আলামত পাইনি। বরং জেনেছি, অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপের অফিস থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি সমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে তাঁরা নিহত হন, আহত হন অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশুসহ অনেকে (নিহত ও আহত পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর ভাষ্য জানার জন্য দেখুন <http:///rottenviews. com/>)। আহত সবাই নানা রকম হয়রানির শিকার হন, চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যেতেও বাধা দেওয়া হয়। গুরুতর জখম হয়ে যাঁরা হাসপাতালে গিয়েছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরানো হয়। (দেখুন <https:///thotkata. net>)।
এলাকায় নতুন অশান্তির শুরু আইনকানুন ও নিয়মনীতি ভঙ্গ করে প্রতারণা ও জবরদস্তির মাধ্যমে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা থেকে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকার গণ্ডামারার বড়ঘোনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে সরকার অনুমতি দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় একটি চীনা কোম্পানি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এস আলম গ্রুপ সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন নামে ওই চীনা কোম্পানির সঙ্গে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। তার তিন বছর পর চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকার এস আলম গ্রুপের দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট ৬ দশমিক ৬১ টাকা দরে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে।
তিন বছর ধরে এসব চুক্তি সম্পাদিত হলেও এলাকার মানুষ এ সম্পর্কে অবগত হন সম্প্রতি। এর মধ্যে কোনো পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষাও করা হয়নি। পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা ছাড়া এ রকম কোনো প্রকল্প কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, এই সমীক্ষা থেকেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব কোন প্রকল্প আসলে কতটা ক্ষতি করবে আর কতটা লাভজনক হবে, আদৌ তা গ্রহণযোগ্য কি না। বস্তুত, প্রথম থেকেই অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, জোরজবরদস্তি, ত্রাস দিয়ে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু। জমি কেনা নিয়েও নানা অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারি অফিসের একটি প্রতিবেদন থেকেই। গত বছরের ৫ নভেম্বর বাঁশখালী উপজেলার ভূমি অফিস এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনই স্পষ্ট করে যে এস আলম গ্রুপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা গোপন রেখে টেক্সটাইল মিলস ও ভেজিটেবল অয়েলের নামে জমি কিনেছিল। ভূমি অফিস গণ্ডামারা, পশ্চিম বড়ঘোনা ও পূর্ব বড়ঘোনা মৌজায় মাত্র ১৫০টি বসতবাড়ি দেখিয়ে জমি হস্তান্তরের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই অঞ্চলে পাঁচ হাজার একর জমি নিজের কর্তৃত্বে আনার প্রয়োজন জানিয়েছে এস আলম গ্রুপ, যার মধ্যে ১ হাজার ৭২৮ একর জমি খাস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, গণ্ডামারা, পশ্চিম বড়ঘোনা ও পূর্ব বড়ঘোনা মৌজায় মাত্র ১৫০টি পরিবারের বসতবাড়ি রয়েছে। ওই সব বসতবাড়ির জমি বাদ দিলে এস আলম গ্রুপ কর্তৃক চাহিদা মোতাবেক বর্ণিত মৌজাগুলোতে ৩ হাজার ১০০ একর ভূমি ব্যক্তিমালিকানাধীন “নাল” শ্রেণি হিসেবে খালি জমি রয়েছে।...’ এ দুটি বাক্যেই দুটি ভুল বা উদ্দেশ্যমূলক ভুল তথ্য আছে।
প্রথমত, এই এলাকায় পরিবার ১৫০টি নয়, সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। আর যে জমি খালি দেখানো হচ্ছে, সেগুলো যে ধানের জমি, লবণ ও চিংড়ি চাষের জমি তা আমরা নিজের চোখেই দেখেছি। তা ছাড়া যে ১ হাজার ৭০০ একর খাসজমি অব্যবহৃত দেখানো হচ্ছে, সেগুলোও ভূমিহীনেরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজেই ব্যবহার করছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী খাসজমি কেবল ভূমিহীনেরাই পেতে পারেন, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়। আমরা জানতে পারলাম, প্রকল্পের স্থান নির্বাচন এবং জমি ক্রয়, অধিগ্রহণসহ নানা অনিয়ম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ প্রতিবাদ করে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও দালালদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছিল মানুষ। বারবার হামলা-হুমকির ঘটনা ঘটেছে। হয়রানি বৃদ্ধির একপর্যায়ে ৩ এপ্রিল এলাকার সাতজনকে গ্রেপ্তার করিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। তার প্রতিবাদেই ৪ এপ্রিলের সমাবেশ ডাকা হয়েছিল।
ঘটনার ১২ দিন পর গত ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন স্বীকার করেছেন, ‘প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি গণ্ডামারায় জমির মালিকেরা প্রকৃত মূল্য পাননি। মাঝখান থেকে কিছু বাটপার দালাল টাকা নিয়ে গেছে। ফলে এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ জন্মেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার অবস্থা এত খারাপ সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। কারণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিষয়টি তাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন।’ কেন এবং কার স্বার্থে তাঁরা এ ভূমিকা রেখেছেন, এ প্রশ্ন এখন এলাকাবাসীর।
জেলা প্রশাসক সেদিন আরও বলেন, ‘পুলিশ আর কাউকে গ্রেপ্তার করবে না। যাঁরা গ্রেপ্তার আছেন, তাঁদের জামিন চাইলে জামিনের ব্যবস্থাও করা হবে। এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।’ (জেলা প্রশাসকের বক্তব্য দেখুন এই ওয়েবসাইটে http:///www. manobkantha.com/ 2016/ 04/16 /119031. php#sthash. PbKck6 Hr. dpuf)
কীভাবে সরকারি প্রশাসনকে বিশ্বাস করবে মানুষ? এ রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও আবারও বাঁশখালী ও ঢাকা থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। না, বাঁশখালী হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, গ্রেপ্তার হচ্ছেন নিহত ও আহত পরিবারের লোকজন, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী মানুষেরা। হাতে অস্ত্র ধরিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। পাশাপাশি এঁদের উদ্দেশেই চলছে হুমকি, ‘নিজের গোরস্থান চিনে রাখো’। ঘটনা বোঝা কঠিন নয়। সামনে ইউপি নির্বাচন। কোম্পানিপন্থী সরকারি প্রার্থীর প্রতি জনসমর্থন নেই, কিন্তু ভূমি গ্রাসের জন্য তাঁকে জেতাতেই হবে। সুতরাং নির্বাচনের এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়েছে ধরপাকড়।
হত্যাকাণ্ডের পর এই প্রচারও চালানো হয়েছে যে বিএনপি ও জামায়াতের উসকানিতে প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু আমরা এলাকায় গিয়ে দেখেছি, সরকারি দলের নেতারা তো বটেই, বিএনপি ও জামায়াতের নেতারাও কোম্পানির সঙ্গে, প্রকল্পের পক্ষে। আর দল–মতনির্বিশেষে এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, তাঁরা এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ এ প্রকল্পের পক্ষে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমে। এই বিজ্ঞাপনে যেসব দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক ও তথ্যভিত্তিক নয়। কীভাবে গরিব গ্রামবাসী এর উত্তর দেবে? তাদের তো আর এত টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। (এ বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক লেখার জন্য দেখুন, http:///ncbd. org/? p= 1529) | <http://ncbd. org/? p= 1529)>| তাই একচেটিয়া প্রচারণার সুযোগ নিয়েই অরক্ষিত বাঁশখালীর মানুষের ওপর আবারও শুরু হয়েছে জুলুম।
এসব জোরজুলুম, নির্যাতন এমনকি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গেলেই কয়লাবিদ্যুতের উপকারিতা বিষয়ে সরকারের নানা পর্যায় থেকে বক্তৃতা শুনতে হচ্ছে। কেউ যদি কয়লাবিদ্যুৎ অপরিহার্যও মনে করেন, তাঁকে কেন অনিয়ম, দুর্নীতি, জোরজুলুম ও হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়াতে হবে? কেন নিয়মনীতি ভঙ্গ করে প্রকল্প করতে হবে? ‘উন্নয়ন’ যদি সত্যিকারের উন্নয়নই হয়, তাহলে পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা না করে জবরদস্তি কেন? তা নিয়ে মানুষের কথা শুনতে অসুবিধা কী? মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়? খোলাখুলি কথা বলতে অসুবিধা কী? না, কেউ কথা বলতে পারবে না, কোনো সভা-সমাবেশ করা চলবে না। সন্ত্রাসী আর পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী লাগানো হবে জনগণের বিরুদ্ধে। এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। একই চেহারা আমরা দেখেছি চারদলীয় জোট আমলে ফুলবাড়ীতে; এখন দেখছি সুন্দরবন, রূপপুরসহ নানা স্থানে। বাঁশখালীতে তার চরম পরিণতিতেই রক্তক্ষয় হলো।
সে জন্য আর উসকানি না দিয়ে সরকারের উচিত হবে প্রথমত, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। দ্বিতীয়ত, জোরজুলুম, গ্রেপ্তার-নির্যাতন বন্ধ করা। তৃতীয়ত, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন করা এবং জনসম্মতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ রাখা।
উন্নয়নের নামে ভূমিগ্রাস, দুর্নীতি ও ধ্বংসের তৎপরতা চললে তা নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হবেই। যথাযথ স্বচ্ছতা, জনসম্মতি এবং জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত না হলে জনগণ কোনো প্রকল্পই গ্রহণ করবে না। ভয়ভীতি কত দিন মানুষকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবে?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]/[email protected]