অবরোধবাসীর দিনমান

কিছুদিন আগে আমার পিতা প্রয়াত হয়েছেন। মা একটি মফস্বল শহরে একাকী নিঃশব্দ জীবন যাপন করেন। তিনি ঢাকাতেও আসবেন না, বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকবেন। আজ যাওয়ার কথা ছিল আমার। কাল সব প্রস্তুতি সমাপন হয়েছে। ওখান থেকে যাব জীবিকার কাজে। একটি শুটিংয়ে। সপ্তাহ পার করে ঢাকায় ফিরব। অকস্মাৎ অজ্ঞাত স্থান থেকে নির্দেশ এল, বৃহস্পতিবার নাগাদ অবরোধ। ১৬ কোটি মানুষ মেনে নিল। আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব একটুও ভাবলেন না এই শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের বলি কারা? সাধারণ জনগণ এবং জনগণ। যাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই তাঁদের কেশও স্পর্শ করতে পারছে না। অফিস, আদালত, মন্ত্রী, সচিব, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংসদ—সবাই যাঁর যাঁর কাজ করছেন। কোনো কিছুই বাতিল হচ্ছে না।
এ রকম অদ্ভুত আন্দোলন কখনো দেখিনি, যেখানে আন্দোলনকারীরা রাজপথে নেই, তাঁদের অফিসেও নেই। আত্মরক্ষার ভয়ে সবাই পলাতক। আন্দোলন করবেন; জেলে যেতে ভয়, নিপীড়নের ভয়! কিন্তু মানুষকে ঠিক ভয় দেখিয়ে ছাড়ছেন। এ কৌশল পৃথিবীতে বিরল ও নতুন। চোরাগোপ্তা হামলা করে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে এমন একটা প্যানিক সিনড্রোম তৈরি করা হয়েছে যে গণমানুষ ভয় পেয়ে গেছে। একই সময়ে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পতদ্যাগের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। সেখানকার বিরোধী দল রাজপথে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলছে। লক্ষ্যবস্তু সরকার এবং সরকার। সাধারণ মানুষ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পথিক, স্কুল-কলেজে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা কিছু জায়গায়। পুলিশ সরকারি ভবন রক্ষায় মরিয়া, আন্দোলনকারীরাও মরিয়া। জেল-জুলুম গুলি—সবই চলছে। আন্দোলনের নেতারাও রণক্ষেত্রে উপস্থিত। কিন্তু এখানে কেউ কোথাও নেই। অথচ অবরোধ হয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের চরিত্রটাই গণবিরোধী। যে বিরোধী দলের লক্ষ্যবস্তু সাধারণ মানুষ, সেই দল গণসমর্থন আশা করে কী করে?
আবার সরকারও সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার বিধান করতে পারছে না। রাস্তায় রিকশা চলে, সিএনজি চলে, বাসও কিছু চলে, কিন্তু গাড়ি চলে না। সরকারি দলের সাংসদ, সদস্য অনেকেরই তো একাধিক গাড়ি আছে, তাঁরা গাড়ি নিয়ে চলেন না কেন? তাহলে তো কয়েক হাজার প্রাইভেট কার যান দেখা যেত। দূরপাল্লার বাস-ট্রাককে নির্বিঘ্ন করতে বাধা কোথায়? সামান্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও সাহস দিলে জনগণ এসব মানবে না। নাশকতার কাজগুলো তো পার্টির নেতারা করেন না। করে ভাড়াটে মাদকাসক্ত দুর্বৃত্তরা। সম্প্রতি দুজন সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে এবং তারা স্বীকার করেছে, চারজনকে বারো শ টাকা দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীরা ক্লোজআপে ছবি তুলেছেন পেট্রল ঢালার, আগুন জ্বালানোর। যথার্থ দায়িত্ব পালন করেছেন বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করলে আরও একটা দায়িত্ব পালন হয়ে যায়।
একদিকে আন্দোলনের নামে অবরোধ চলছে, অন্যদিকে গার্মেন্টস কারখানায় আগুন দেওয়া হচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এই যে সহজলভ্য গান পাউডারের আমদানি ও সহজ উপায়ে ভ্রান্তপথে দাবি আদায়ের চেষ্টা, তার পরিণাম কী হবে, তা কি ক্ষমতালোভী রাজনীতিকেরা ভাবতে পারেন? আমাদের দেশের শিক্ষিতজনদের মধ্যে একদল মানুষ আছেন, যাঁরা ভাবেন আজকের সূর্যাস্তই পৃথিবীর সর্বশেষ সূর্যাস্ত। অতএব যা কিছু করার, যা কিছু ভোগ করার, এখনই করতে হবে। পরদিন সূর্য ওঠার বৈজ্ঞানিক সূত্রটি তাঁরা ভুলে যান। দ্রুত রাজনীতিক হয়ে ওঠা, দ্রুত অর্থের মালিক হওয়া, দ্রুত পদোন্নতি—সবকিছু আজই চাই। তাই সেই নিষ্ঠুর রথের চাকায় ধ্বংস হচ্ছে জনমত, ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে মানুষের পৃথিবী। শাসকগোষ্ঠীর কোনো অসুবিধা নেই। বাইরের জানালা তাঁর খোলা। কিন্তু পুড়ে মরবে, না খেয়ে মরবে দেশের মানুষ।

হায় রে ওয়েজ...
মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে, মালয়েশিয়ায়, ইউরোপে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় যাঁরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছেন; একচিলতে স্বপ্ন, সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা নিয়ে যাঁদের দিনরাত, তাঁদের কথা কেউ কি ভাবছেন?

হায় রে গার্মেন্টস কর্মী
রানা প্লাজার ধসে যাঁরা প্রাণ দিলেন, অঙ্গ হারালেন, অনিশ্চিত জীবনে সামান্য আশা নিয়ে বেঁচে আছেন, ঘটনার রেশ না কাটতেই বিশাল অগ্নিকাণ্ডে আবার হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মী বেকার। তাঁদের কথা কে ভাববে?

হায় রে কৃষক
পাঁজর ভাঙা কৃষককুল। ফসলের দাম পাবেন কি? পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, বীজ নিয়ে আশা, ঠিকমতো বোনার কাজটি কি হবে?

হতভাগ্য শিশু-কিশোর তরুণ শিক্ষার্থী
প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, আবার জীবন থেকে খসে যাওয়া দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কোথায় ফিরে পাবে এ দিনগুলো?
আমার একটা প্রশ্ন। যাঁদের আমরা ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাই, নেতা বলে মেনে নিই, তাঁরাই তো এসব নিষ্পত্তি করবেন। এত বড় একটা সংসদ ভবন করে ফিরেছি। বিনা শুল্কে গাড়ি দিয়েছি, তাঁদের হোস্টেল থাকা সত্ত্বেও দিয়েছি ন্যাম ভবনগুলোতে থাকার ব্যবস্থা, বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছি, বিদেশে যাওয়ার কত সুযোগ করে দিয়েছি। এত সব সত্ত্বেও কেন বছরের পর বছর রাজপথ ব্যবহার করতে হবে?
আন্দোলনে কোনো রুটি-রুজির বা জীবনের মান উন্নয়নের বিষয় নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা বানচাল করার একটা গুরুতর ব্যাপার আছে এর মধ্যে। তাই ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষ পুড়িয়ে ওদের বাঁচাতে হবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি এখন জামায়াত। তাই অন্য সব ইস্যু মুখ্য নয়। জামায়াত দেশকে দুঃস্বপ্নের জায়গায় নিয়ে গেছে। মহান সুফি সাধকদের যে বিনম্র শান্তির ধর্মচিন্তা, যাতে স্থানীয় সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়ার প্রবণতা ছিল, তার বিপরীতে জামায়াত নেমেছে কৃষ্টি ধ্বংসের মহোৎসবে। এই অবরোধে যেমন মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি সংকটাপন্ন হয়েছে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি।
দুটি দলই ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী। এতে দোষের কিছু নেই। আওয়ামী লীগে অনেক ত্যাগী কর্মী আছেন, হয়তো অনেকেই নিষ্ক্রিয়। বিরোধী দলের সেদিক থেকে ত্যাগী কর্মীর সংখ্যা কম। দুই দলের কর্মীদের মধ্যেই রাজনীতি সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথা শুনেছি। কিন্তু তাঁর ফল শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমার মনে হয় তাঁরা কেউই সংঘাত চান না। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারও চান না।
দেশের মানুষের, ত্যাগী কর্মীদের বুকভাঙা বার্তা শীর্ষ নেতাদের কানে কবে পৌঁছাবে। আজকেই যদি পৌঁছে যায়, তাহলেই মঙ্গল। দেশের কোটি কোটি সন্তান যেন নির্বিঘ্নে মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা চাই।
আমাদের সন্তানদের দুধে ভাতে উপদ্রব বন্ধ হোক।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।