আমার ছাত্র ও সহকর্মী তারেক

জাহাঙ্গীর তারেক
জাহাঙ্গীর তারেক

আজ, ২৯ জুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তারেকের (১৯৪৩-২০১০) মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে আমি ছাত্র ও সহকর্মীরূপে পেয়েছিলাম। তার মৃত্যুতে আমি অনেক আঘাত পেয়েছি।
জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, বরিশালে। বেতাগী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করে সে বাংলায় অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। আমি তখন বিভাগের তরুণ শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগ ছিল। জাহাঙ্গীরের মেধার পরিচয় পেতে আমার দেরি হয়নি। সে কথাবার্তা কম বলত, তবে তার স্বভাবজ হাস্যরসিকতা খুব উপভোগ্য ছিল। ছাত্র হিসেবে সে যেমন মনোযোগী ছিল, তেমনি ছিল ভালো পড়ুয়া। তার পড়াশোনা পাঠ্যতালিকার বাইরেও অনেকদূর বিস্তৃত ছিল।
১৯৬৪ সালে এমএ পাস করে জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজে শিক্ষকতায় প্রবেশ করে। অনেক দিন সে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে কাজ করে। বোধ হয় চট্টগ্রামে থাকতেই সে ফরাসি ভাষা ভালোমতো আয়ত্ত করে এবং একসময়ে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে চলে যায়। সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে প্রথমে ফরাসি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করে, তারপর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে ইংরেজি সাহিত্যে। শেষে আবার সোরবোন থেকে ডি. লিট. উপাধি পায়—তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের তুলনামূলক বিচার। দেশে থাকতে সে আরও কয়েকটি ভাষা শেখার উদ্যোগ নিয়েছিল, প্যারিসে গিয়ে সে-অনুশীলন আরও সম্প্রসারিত হয়। বস্তুতপক্ষে একের পর এক ভাষাশিক্ষা তার নেশা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ইতালীয় ও রুশ ভাষা সে আয়ত্ত করেছিল, সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি ভাষাও শিখেছিল খানিক খানিক।

১৯৭৭ কি ১৯৭৮ সালে জাহাঙ্গীর দেশে ফিরে আসে। সে আশা করেছিল, তার তিনটি মাস্টার্স ও একটি ডক্টরেটের জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাবে। তার সে–আশা তখন পূরণ হয়নি। সে-সময়ে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তাকে সেখানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাই। সে সম্মত হয়। অ্যাডহক ভিত্তিতে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে সে নিযুক্তি পায়। এই পদে সাধারণত অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ ঘটে না। কিন্তু তার বিদ্যায়তনিক সাফল্য এবং ভাষাজ্ঞানের বহর দেখে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়োগ দিতে দ্বিধা করেননি। কিছুকাল পর জাহাঙ্গীর নিয়মিত নিয়োগ পায় এবং আর-কিছুকাল পর বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব লাভ করে।

ইতিমধ্যে সে বিয়ে করে এবং ঢাকায় চলে আসতে আগ্রহী হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপকের পদ বিজ্ঞাপিত হলে সে আবেদন করে এবং কাজটি পায়। পরে আশির দশকের শেষদিকে সেখানে সে অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়। তার এবারের নির্বাচকমণ্ডলীতে আমি একজন সদস্য ছিলাম। প্রার্থীদের মধ্যে আমার প্রথম মনোনয়ন সে পায় এবং অন্য সদস্যরা আমার সঙ্গে একমত হন। পরে জাহাঙ্গীর ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক-পদেও অধিষ্ঠিত হয়। এখানে থাকতে আবার প্যারিসে গিয়ে সে আধুনিক শিক্ষার কলাকৌশল সম্পর্কে এক শিক্ষাবর্ষ অনুশীলন করে এল এবং মর্যাদাপূর্ণ হামবোল্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে মিউনিখে আরেক শিক্ষাবর্ষ গবেষণায় রত থাকল।

পাশাপাশি জাহাঙ্গীর ইংরেজি ও ফরাসি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ফরাসি ও স্প্যানিশে বেশ কিছু অনুবাদ করে। ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারির অনুবাদ তার মধ্যে একটি। নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের ফরাসি ও স্প্যানিশ অনুবাদ খুবই উল্লেখযোগ্য। তার অন্যান্য অনুবাদগ্রন্থের মধ্যে উলম্যানের শব্দার্থবিজ্ঞানের ভূমিকার কথা এখানে বলতে হয়। কিন্তু ভাষা-সাহিত্যের বাইরেও তার যে-সজীব কৌতূহল, তা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-বিষয়ের বইয়েরও অনুবাদ করতে। ম্যানচেস্টারের কারিগরি বিদ্যার দিশারি এবং লুন্ডবার্গের সামাজিক সংকটে বিজ্ঞানের ভূমিকা তারই নিদর্শন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আমি যখন আইন-শব্দকোষ সংকলনের দায়িত্ব নিই, তখন আমার আহ্বানে জাহাঙ্গীর আমাদের সহযোগীর ভূমিকা নিতে স্বীকার করে এবং ওই প্রকল্পের সবাই তার কাজের প্রশংসা করেন। তার আগেও অবশ্য বাংলা একাডেমির বাংলা-ইংরেজি ও ইংরেজি-বাংলা অভিধানের সংকলন ও সম্পাদনায় সে অন্যতম সহযোগী সম্পাদক ছিল। তার বেশ কিছু মৌলিক রচনা নানা ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রতীকবাদী সাহিত্য তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

মানুষ হিসেবে জাহাঙ্গীরকে আমি উঁচু মাপের বলে মনে করেছি সব সময়। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরে তার মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে থাকলে সে আরও কিছু আমাদের দিতে পারত। তাকে স্মরণ করে যে আজ আমাকে লিখতে হচ্ছে, সে আমার বড়ই দুর্ভাগ্য।

আনিসুজ্জামান: লেখক  শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়