ভিক্তর হারার নবজীবন

শৃঙ্খলমুক্তির গানের কবি ভিক্তর হারা
শৃঙ্খলমুক্তির গানের কবি ভিক্তর হারা

ভিক্তর হারার মৃত্যুর কথা কারও অজানা নয়। লাতিন আমেরিকার আলম্ববিস্তৃত দেশ চিলিতে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন বলদর্পী এক জেনারেল। আর তাঁর সেই ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করে নিতে তাঁকে হত্যা করতে হয়েছে সেই সব মানুষকে, আজীবন যাঁরা মানুষের কথা বলে গেছেন, মানুষের পাশে দুর্দিনে যাঁরা অবস্থান করেছেন। সেই দলে আছেন পাবলো নেরুদার মতো কিংবদন্তির কবিতে পরিণত হওয়া ব্যক্তিত্ব; আছেন সালভাদর আলেন্দের মতো চিকিৎসক, মানুষের রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে একসময় যিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অসুস্থ সমাজকে রোগমুক্ত করা না গেলে বৃথাই যাবে অন্য সব রকম চিকিৎসা; এ ছাড়া আরও আছেন সেই সব তরতাজা তরুণ—সাম্য আর ভ্রাতৃত্বের স্বপ্ন যাঁদের করেছিল উদ্বেলিত এবং সব শেষে অবশ্যই আছেন সেই গায়ক ভিক্তর হারা, গিটার হাতে তুলে নিয়ে রাজপথে হেঁটে যেতে যেতে মানুষকে যিনি শুনিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখার গান, শৃঙ্খলমুক্তির গান। আর গান গাইতে গাইতেই মৃত্যুর পথে সেদিন তিনি করেছিলেন পদচারণ।
দর্পিত জেনারেল মনে করে নিয়েছিলেন, মৃত্যুতেই তিনি শেষ করে দিতে পারবেন কতিপয় মানুষের তাবৎ পরিচয় আর অস্তিত্ব। ফলে জেনারেলের কর্তৃত্বের দিনগুলোতে চিলিতে সেই সব নামের উচ্চারণও ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যেমনটা আমাদের দেশেও কিছু কিছু নামের বেলায় আমরা হতে দেখেছি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখময় সময়ে। তবে তারপরও ইতিহাস এর গতিপথ ধরে এগিয়ে যায়। ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় ইতিহাসের তলানিতে জমা করে রাখা দুর্গন্ধময় আবর্জনা। নৃশংসভাবে খুন হওয়ার প্রায় ৪৩ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার আদালতের দেওয়া রায়ে ভিক্তর হারার হত্যাকারীর শাস্তি হওয়া আবারও প্রমাণ করছে, ইতিহাসকে গায়ের জোরে নিজের ইচ্ছের পথে চালিত করা যায় না, সেই চেষ্টা যত শক্তিধর-বলদর্পী খলনায়কেরাই করুন না কেন।
ভিক্তর হারার করুণ মৃত্যু অনেকটা যেন চিলির সাম্প্রতিক ইতিহাসের করুণতম অধ্যায়েরই বিশ্বাসযোগ্য অথচ চোখ ভিজিয়ে দেওয়া প্রতিফলন। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানের ঠিক পরপর সামরিক বাহিনীর কয়েকটি ট্রাক এসে দাঁড়ায় সান্তিয়াগোর সরকারি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে, যেখানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভিক্তর। উর্দিধারীরা ঘেরাও করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় ভিক্তরের পাশাপাশি তাঁর অন্য কয়েকজন সহকর্মী ও ছাত্রকে, যাঁরা সবাই ছিলেন আলেন্দের বামপন্থী সরকারের সমর্থক ও আন্দোলনের মাঠপর্যায়ের কর্মী। গন্তব্য—চিলির জাতীয় স্টেডিয়াম, যেখানে কাঁটাতারের বেষ্টনীর আড়ালে উন্মুক্ত জায়গায় বন্দী করে রাখা হয় এঁদের পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন গন্তব্য থেকে ধরে আনা আরও কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে। খাদ্য, পানি, জীবন—কোনো কিছুর কোনো রকম নিশ্চয়তা সেখানে একেবারেই ছিল না। ফলে বন্দীদের সহজেই হতোদ্যম হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি ছিল সেটা। সে রকম অবস্থায় সহ-বন্দীদের ভেঙে পড়া মনোবল চাঙা করে তুলতে ভিক্তর শুরু করেছিলেন তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান, যে কণ্ঠে তাল মিলিয়ে অন্যরা ফিরে পেয়েছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবনকে উপলব্ধি করতে পারার প্রেরণা।
তবে কবিতা, গান আর মানুষের জীবনে যা কিছু সুন্দর, তার বিরোধিতা করে যাওয়া উর্দিধারীদের সেটা অপছন্দ হওয়ারই কথা এবং হয়েছিলও তা-ই। বন্দীদের থেকে ভিক্তরকে আলাদা করে দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং এরপর তাঁর ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। যে আঙুল গিটারের তারে তুলত জীবনের জয়গান গাওয়া সুর, দুই হাতের সেই সব অনুভূতিপ্রবণ আঙুলগুলো থেঁতলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর ওপর চলে নির্মম প্রহার। আর যারা সেই উন্মত্ততায় ছিল মত্ত, তারা তখন চিৎকার করে বলছিল, ‘জীবনে আর যেন গিটার হাতে তুলে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোর মনে দেখা দিতে না পারে, সেটাই আমরা নিশ্চিত করে নিচ্ছি।’
শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বর্বরদের সেই পাশবিক আচরণ। এত অত্যাচারের পর তাঁকে টেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্টেডিয়ামের লকার ঘরে, যেখানে সেদিনের তরুণ এক সামরিক কর্মকর্তা পিস্তল তাক করে পরপর দুটি গুলি ছুড়েছিলেন ভিক্তরের মাথার পেছনের দিকে। তাঁরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন, ঘটনার সেখানেই শেষ। ক্ষমতার রজ্জু যেহেতু তাঁদের হাতে ধরা, কাকে কীভাবে মারা হলো সেই প্রশ্ন তোলার সাহস তখন কে আর দেখাতে এগিয়ে আসবে? তবে ইতিহাস সময়মতো ঠিকই কথা বলে। সময় এলে ইতিহাস ঠিকই উন্মোচন করে দেয় এর বন্ধ করে রাখা ডালা। চিলির সামরিক বাহিনীর সেদিনের সেই তরুণ কর্মকর্তা পেদ্রো পাবলো বারিয়েন্তোসের বেলাতেও ঠিক সে রকমই ঘটেছে।
আমরা জানি, ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে চিলিতে গণতন্ত্রের সুবাতাস আবারও বইতে শুরু করলে অজান্তেই হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায় একসময়ে দাপটে বিচরণ করা শকুনদের। পালানোর পথ তখন এরা হাতড়ে বেড়ায়। পেদ্রো পাবলোর বেলাতেও ঘটেছিল ঠিক তা-ই। পরিচয় গোপন করে দেশ থেকে পালিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। তবে সময় তাঁকে ঠিকই খুঁজে বের করে নেয়। ভিক্তর হারার পরিবারের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালে দায়ের করা মামলায় ফ্লোরিডার আদালত পেদ্রো পাবলোকে ভিক্তরের হত্যার জন্য দায়ী করে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। আর সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৪৩ বছর পর পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি ভিক্তরের বিদেহী আত্মাও এখন নিশ্চয় খুঁজে পাচ্ছে নির্মল প্রশান্তি।
আমরা কল্পনা করে নিতে পারি, স্বর্গের উদ্যানে হাতে ধরা গিটারে স্বপ্নিল সুর তুলে ভিক্তর গেয়ে চলেছেন সেই গান, যে গান একদিন তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর দুঃখিনী মায়ের কথা মনে করে:
তোমাকে আমার মনে পড়ে আমান্দা,
বৃষ্টিভেজা পথে যেদিন তুমি দৌড়ে গিয়েছিলে
কারখানার ফটকে
ম্যানুয়েলের যেখানে হবে কাজের বিরতি,
চুল তোমার ভেজা বৃষ্টির পানিতে
মুখে তোমার হাসি...
আসুন, আমরা আরও কল্পনা করে নিই সেই স্বর্গীয় দৃশ্যপটে গান গেয়ে পথচলা ভিক্তরের সঙ্গে একে একে আরও যোগ দিচ্ছেন সালভাদর আলেন্দে, পাবলো নেরুদাসহ ভিক্তরের সেই সব বন্ধু-সহকর্মী, একই দুর্ভাগ্যের শিকার সেদিন যাঁদের হতে হয়েছিল। আর স্বর্গীয় সেই দৃশ্য কল্পনা করে নিয়ে আনন্দের অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে ভিক্তরের বেঁচে থাকা স্ত্রী জোয়ান আর কন্যা মানুয়েলার কপোল।
টোকিও, ২৯ জুন ২০১৬
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।