শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ হোক

.
.

সেদিন এক বন্ধু ফোনে জানাল, তার এক ভাতিজাকে স্কুলে ভীষণভাবে পেটানো হয়েছে। শরীরে জখমের চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। শিশুটি ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ঘটনা শুনে আমি হতভম্ব ও ক্ষুব্ধ হলাম। বন্ধুকে জানালাম যে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে এক পরিপত্রের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং অভিভাবকদের এ-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলেছে। ওই মুহূর্তে শিশুর আরও খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা থেকে শিশুটির মা-বাবা বিষয়টি নিয়ে সামনে এগোতে রাজি হলেন না। তবে পরে মত পাল্টে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন। প্রধান শিক্ষক তাঁদের এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু এই আশ্বাসবাণী যে ঠিক থাকবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১২-১৩ প্রকাশ করে। এ থেকে জানা যায়, যে মাসে জরিপ চালানো হয়েছে, তার আগের মাসে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের মানসিক নির্যাতন কিংবা শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। ‘শৃঙ্খলা’ কিংবা ‘শাসনের’ নামে মা-বাবা, শিক্ষক, নিয়োগকর্তা ও শিশুদের দেখভালকারীরা তাদের শারীরিক শাস্তি দিয়েছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু কিংবা গৃহকর্মী শিশুদের শারীরিক শাস্তির ভয়ংকর অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়। আবার দেশের আনাচ–কানাচে শিশুদের শারীরিক শাস্তির অনেক ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। এমন অনেক শাস্তি আছে, যেগুলো ঠিক শারীরিক শাস্তি নয় কিন্তু শিশুর জন্য নির্দয় ও অবমাননাকর। যেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলা, লাঞ্ছিত করা, হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো কিংবা উপহাস করা ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো আমরা কি শিশুর শারীরিক শাস্তির সত্যিকারের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন? বিশ্বজুড়ে শিশুদের শারীরিক শাস্তিবিরোধী আন্তর্জাতিক জোট ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু এন্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন’ ১৫০টিরও বেশি গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে শারীরিক শাস্তি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং সমাজের জন্য সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে উল্লিখিত শিশু অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই ধরনের শাস্তি শিশুদের শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের মা-বাবা, শিক্ষক ও শিশুর দেখভালকারীদের মধ্যে শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, শারীরিক শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ করতে শেখায়। কিন্তু গবেষণা থেকে জানা যায়, শারীরিক শাস্তি শিশুদের সমাজবিরোধী বা অসামাজিক আচরণে উৎসাহিত করে এবং পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে। শারীরিক শাস্তি শিশুদের মধ্যে সহিংস মনোভাবের বিস্তার ঘটায়, তারা সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়। বড় হওয়ার পরও তারা একই আচরণ করে।
শিশুদের শারীরিক শাস্তির উচ্চহার মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা এই ধরনের শাস্তি দেওয়াকে অনুমোদন করে। এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা দরকার। আমাদের প্রায়ই শুনতে হয় যে মা-বাবা ও শিক্ষকেরা শিশুদের এক-আধটু পেটান, এটা খুবই সাধারণ ঘটনা যা অনেক বছর ধরে চলে আসছে। কেউ কেউ এমন দাবিও করেন যে মা-বাবা ও শিক্ষকেরা শাস্তি দিয়েছিলেন বলেই তাঁরা বড় হয়েছেন। এভাবেই দীর্ঘকাল ধরে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার চর্চা চক্রাকারে চলছে। এখন সময় হয়েছে এই চক্র ভাঙার।

>শিশুদের শারীরিক শাস্তির উচ্চহার মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা এই ধরনের শাস্তি দেওয়াকে অনুমোদন করে। এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা দরকার

শারীরিক শাস্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া আমাদের বন্ধ করতে হবে। যেমন প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে জনাকীর্ণ ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে, তখন ক্লাসরুমে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শিক্ষকদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু আমরা কি কখনো শুনেছি যে কাজের ধকল সহ্য না করতে পেরে একজন শিক্ষক তাঁর সহকর্মীকে চড়-থাপ্পড় মেরেছেন? যদি তিনি তেমনটা করেনও সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? আমরা কেউ কি কর্মক্ষেত্রে আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে এমন সহিংস আচরণ করি? অথচ এই আমাদেরই অনেকে কী ব্যক্তিজীবনের কিংবা কর্মজীবনের হতাশা থেকে নিজ সন্তানকে বকাঝকা করছি না কিংবা মারছি না? তার মানে শিশুর মানবিক মর্যাদাহানি ও শারীরিক নির্যাতন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কিংবা স্বাভাবিক বিষয়। শিশুদের বেড়ে ওঠা ও পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদের দিক থেকে তাদের ভালোবাসাপূর্ণ সঠিক পথনির্দেশনা দেওয়া দরকার, শাস্তি নয়।

শিশুদের শারীরিক শাস্তি বন্ধ করতে যা করা যায়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে সরকারের জারি করা পরিপত্রের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং আইন লঙ্ঘনকারী শিক্ষকদের বিচারের আওতায় আনা। শারীরিক শাস্তি দেওয়া বৈধ এমন সব আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো অবশ্যই বিলোপ করা উচিত।
সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, স্কুল, কর্মক্ষেত্র, ডে কেয়ার সেন্টার ইত্যাদি) শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন পাস করা উচিত। শিশুদের শারীরিক শাস্তি বন্ধ করতে আইন সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, যাতে করে নতুন আইন সম্পর্কে ছোট-বড় সবাই সমানভাবে জানতে পারে। এর মাধ্যমে শিশুরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে এবং প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের মানবিক মর্যাদা দিতে উদ্বুদ্ধ হবে।
শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়াকে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রচারণা চালাতে হবে। বাড়িতে ও স্কুলে অবশ্যই ইতিবাচক শৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যে ব্যবস্থায় সহিংসতা থাকবে না। মা-বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও স্কুলশিক্ষকদের অহিংস পন্থায় শিশুর লালন-পালন ও শিক্ষাদান করার জ্ঞান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশু লালন-পালনসংক্রান্ত সব ধরনের প্রশিক্ষণে ইতিবাচক শৃঙ্খলা শেখানোর পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
লায়লা খন্দকার: পরিচালক, চাইল্ড প্রটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন।