মুসলিম রাষ্ট্রে আইএসের সহিংসতার ধরন বদলেছে

প্রথম খুন হন এক জগার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার এক ছায়াঢাকা কূটনৈতিক মহল্লায় দৌড়াতে বেরিয়েছিলেন। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জানা যায়, তিনি ৫০ বছর বয়সী এক ইতালিয়ান সাহায্যকর্মী। পুলিশ জানায়, সাদা চামড়ার যেকোনো বিদেশিকে খুন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল হত্যাকারীদের।
অক্টোবরে খুন হন একজন জাপানি। নভেম্বরে একজন ক্যাথলিক যাজককে আহত করা হয় মোটরসাইকেল থেকে গুলি ছুড়ে।
সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ইউরোপে তাদের সহযোগীদের পরামর্শ দেয় সেখানে ‘যে কেউ ও সকলকে’ হত্যা করতে। তবে বাংলাদেশে তাদের কৌশল অনেক নিয়ন্ত্রিত। গত নয় মাসে এখানে আইএস ১৯টি হামলার দাবি করেছে। এসব হামলার প্রায় সবাই ছিলেন হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নয়তো বিদেশি। ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন একজন হিন্দু ব্যক্তি, শিয়া ধর্মপ্রচারক, ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়েছেন এমন ব্যক্তি। এর মধ্যে শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে সিরিয়া ও ইরাকে আইএসআইএল গণহারে নরহত্যা চালিয়েছে। আর এসব হামলায় সংগঠনটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পশ্চিমা দেশগুলোকেও অনুপ্রাণিত করেছে—এর মধ্যে প্যারিস ও ব্রাসেলসে পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় করে হামলা হয়েছে, ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে নাইট ক্লাবে গণহারে হয়েছে গুলি—সবগুলোতেই খুনিরা বাছবিচারহীন মানুষ খুন করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যে হামলার দাবি আইএস করেছে, সেটার দিকে ভালো করে তাকালে দেখা যায়, এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি অঞ্চলভেদে কৌশল বদল করছে। ভিন্ন এক গোষ্ঠীর মনোযোগ এখানে তাদের কাম্য। এটাও দেখা দরকার যে গোষ্ঠীটি গত সপ্তাহে তুরস্কের বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বিস্ফোরণের দাবি করেনি।
সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের পরিচালক রিটা কাটজ সম্প্রতি অনলাইনে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, ‘অনুগামী ব্যক্তিদের মধ্যে সমর্থন বজায় রাখার জন্য আইএসকে মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলোতে হামলার পরিকল্পনায় ভিন্ন ভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশে আইএস গণহারে খুনকে উৎসাহিত করে। কিন্তু তুরস্কের মতো দেশে আইএসকে নিশ্চিত হতে হয় যেন কোনো মুসলিমকে হত্যা না করা হয়। অথবা তাদের অন্তত দেখাতে হয় যে তারা মুসলিমদের খুন করে না।’
কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কে আল-কায়েদা থেকে আইএস যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল সুন্নি মুসলমানদের হত্যা করা হবে কি হবে না—এই ইস্যু। গত সপ্তাহে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
গত সপ্তাহে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ওই হামলার জন্য যখন আইএসকে দায়ী করা হচ্ছে, তখন আবু সুলায়মান আল-মুহাজির নামে সিরিয়ায় আল-কায়েদা শাখার একজন অস্ট্রেলিয়ান সদস্য টুইটারে একটি পোস্ট দেন। এতে বলা হয়, তুরস্কের মানুষ মুসলমান, তাদের রক্ত পবিত্র। সত্যিকারের মুজাহিদ তাদের জন্য জীবন দেবে, জীবন নেবে না।
যেকোনো বোমা হামলা হলে যেখানে আইএস দ্রুত দায় স্বীকার করে, সেখানে ইস্তাম্বুল হামলা নিয়ে আইএসের আশ্চর্যজনক নীরবতা প্রমাণ করে, মুসলিমপ্রধান দেশে সহিংস হামলার ক্ষেত্রে তাদের ভারসাম্য রাখতে হয়। রিটা কাটজ বলেন, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে হামলার ক্ষেত্রে আইএস সাধারণ বেসামরিক নাগরিকদের চেয়ে সরকারি স্থাপনা ও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত মাসে জর্ডানের প্রথম বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল একটি মার্কিন-জর্ডানি সামরিক ঘাঁটি। মে মাসে সুন্নি–অধ্যুষিত সৌদি আরবের একটি শিয়া মসজিদে তারা বোমা হামলা চালায়। জানুয়ারিতে জাকার্তায় তারা স্থানীয় ব্যক্তিদের বদলে শুধু পর্যটকদের ওপর হামলা করে।
বাস্তবে আল-কায়েদা ও আইএস উভয়েই তাদের হামলাগুলোতে বিপুলসংখ্যক মুসলমানকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা এ নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করেনি।
গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় আইএসের সর্বশেষ হামলার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হামলাকারীদের লক্ষ্য অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট ছিল, যেটা আইএসের ক্ষেত্রে আগে বেশি দেখা যেত না। বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা রেস্তোরাঁটি খুব পছন্দ করতেন, কারণ সেখানে আমেরিকান খাবার খাওয়া ও আরামে সময় কাটানো যেত।
শনিবার আইএস হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে। তাদের পরিচয় দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন শত্রুরাষ্ট্রের (ক্রুসেডার নেশন) মানুষদের আক্রমণকারী’ হিসেবে। এই অবস্থায় আইএসের এমন বক্তব্য স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, তারা এই হত্যাকাণ্ডকে বিশেষভাবে ‘অমুসলিমদের’ হত্যা হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে।
অনুবাদ: কুন্তল রায়
রুকমিনি কালিমাচি: সাংবাদিক, নিউইয়র্ক টাইমস।