ঐকমত্যের সন্ধানে

জনগণের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করুন
জনগণের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করুন

জনগণ একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। স্বাধীনতার প্রত্যয় ছিল, ক্ষমতা জনগণের কাছে থাকবে এবং তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি কার্যকর সংসদের মধ্য দিয়ে তার প্রয়োগ ঘটবে। আমাদের এমন রাজনৈতিক দল দরকার, যারা তৃণমূল থেকে শক্তি সঞ্চয় করবে। যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল আজ নেই। এর অভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা রাজনীতি থেকে মুছে গেছে। এখন আপনারা গণতন্ত্রের মুখোশটাই দেখছেন। এর আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে দল এবং রাষ্ট্র পরিচালনাগত স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা। সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্জীবন এবং চারটি সাধারণ নির্বাচন (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) অনুষ্ঠান সত্ত্বেও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য জনগণের প্রত্যাশা অপূরণীয় থেকে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অপব্যবহার ঘটেই চলেছে। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন অনুপস্থিত। ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদার প্রতি তাদের ঝোঁক প্রচণ্ড ও সুস্পষ্ট। এসবই রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর করে তুলছে রাজনীতিকে। এর সর্বনাশা প্রতিক্রিয়ায় সরকারগুলো হয়ে পড়েছে ‘ক্ষমতাসীন দলের কোটারির’ দ্বারা, ‘ক্ষমতাসীন দলের কোটারির’ জন্য এবং ‘ক্ষমতাসীন দলের কোটারি’ শাসন। রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল থেকে শক্তি আহরণের কোনো চেষ্টাই করছে না। বরং তারা শীর্ষ অবস্থান থেকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ভয়ানক প্রবণতা দেখিয়ে চলেছে।
দলের একজন নেতার হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে। মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনসাধারণের মতামতের প্রতিফলন ঘটছে না। এটা এখন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কথিতমতে এটা এখন প্রায়শ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে খরিদ করা হচ্ছে। কতিপয় রাজনৈতিক পরিভাষা রুগ্ণ রাজনীতির আলামত বহন করছে। যেমন ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ মনোনয়নপত্র কেনাবেচার ইঙ্গিত বহন করছে। ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ প্রমাণ বহন করছে উপচে পড়া ব্যালট বাক্সের। এমনকি ভোটাররা যেখানে অনুপস্থিত কিংবা তাদের জবরদস্তি বা ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় না, সেখানেও ভোটের বাক্স ভরে যায়। আর ‘মিডিয়া ক্যু’ কথাটি গণমাধ্যমে ভুয়া ফলাফল ঘোষণার লক্ষণবাহী।
নির্বাচন-প্রক্রিয়া তিনটি বিষয়ের সংক্রমণে নাজুক হয়ে আছে। অর্থ, পেশিশক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে নির্বাচন করার খরচ হু হু করে বেড়ে গেছে। আইনগত ব্যয়সীমা হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। এরও লঙ্ঘন চলছে। দায়মুক্তিও চলছে। সম্প্রতি ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তবে তাতে দায়মুক্তিসংক্রান্ত ধারণার কোনো হেরফের ঘটবে না; বরং নিরঙ্কুশ দায়মুক্তির সুবিধা ভোগের মওকা আরও তীব্র হতে পারে। কারণ, সত্যিই কত খরচ করা হবে, তা তদারকির কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।
নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় কালো টাকার অবাধ অনুপ্রবেশ মানুষের ভোটের অধিকার প্রকারান্তরে খর্ব করছে। কারণ, তাঁরা সৎ এবং যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছেন। ২০ বছর ধরে বারবার একটি ‘বৃহৎ’ দল থেকে আরেকটি ‘বৃহৎ’ দলের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। আর তাদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরে জনগণ অনুশোচনা করেছে। কারণ, তারা দেখেছে তাদের স্মৃতির খাতায় কেবলই বড় বড় বুলি অবশিষ্ট রয়েছে। আর বাস্তবে পরিবর্তন এসেছে যৎসামান্যই। পরিবর্তনের জন্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য, তা আগের মতোই চলনশক্তিরহিত। এর পরিবর্তে ‘সংস্কার’ শব্দটিকেই সমাহিত করা হয়েছে। বরং ‘সংস্কারপন্থীদের’ পদাবনতি ঘটেছে। এবং তাঁদের ঠাট্টার পাত্রে পরিণত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলীয়করণের বিদ্বেষবিষ বিপজ্জনকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের মুখ্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ পরিচালনা ও পরিচর্যার জন্য নিরপেক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওই সর্বগ্রাসী দলীয়করণ আমাদের নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ এবং জনপ্রশাসনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যুব্জ ও দুর্বল করে রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অধিকতর মেধাবী প্রার্থীদের চেয়ে দলীয় অনুগতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকমিশন—সুযোগ্য জনসেবকের নিয়োগ যাদের নিশ্চিত করার কথা, সেই সংস্থাও দলীয় অনুগতদের কবলে পড়েছে। এতে আইনের শাসন ও নিরপেক্ষ বিচারকার্য পরিচালনায় ক্ষয় এসেছে।
বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের বিচার হয়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তাঁদের কারণে হাজার হাজার মানুষ পথে বসেছে। বড় ধরনের ব্যাংক জালিয়াতি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ব্যক্তির জানমালের নিরাপত্তাহীনতার বোধ প্রকট হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে কার্যকর তদন্ত ও অনুসন্ধান আর আশা করা যায় না। অন্যদিকে দলীয় অনুগতদের জন্য সর্বাত্মক দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনকি যাঁরা খুনের মতো মারাত্মক অপরাধের দায়ে দণ্ডিত তাঁদেরও মার্জনা করা হয়।
আজ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে বহুদলীয় ব্যবস্থার মধ্য থেকে নিরপেক্ষতার শিকড় উপড়ে ফেলা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অনেকগুলো নির্বাচন বয়কটের কারণ ছিল। ’৮৬-এর সংসদ নির্বাচনের পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বয়কট হলো। বয়কট হলো ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন। আর এটাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১-এর নির্বাচন এনে দিল। সাংবিধানিক বিধানাবলি থেকে এ ক্ষেত্রে যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, তা শোধরাতে পাস হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনী। ১৯৯৫ সালে মাগুরার কুখ্যাত উপনির্বাচন ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনকে বয়কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এরপর সৃষ্টি হলো ৯০ দিন মেয়াদে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ প্রশাসনের বিধান রেখে ত্রয়োদশ সংশোধনী। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন সব বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর প্রধান যুক্তি ছিল নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানকে নিরপেক্ষ বিবেচনা করা সম্ভব হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ নির্দলীয় প্রশাসন এবং পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের নির্বাচন সম্পন্ন করল।
এটা প্রহসনমূলক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যারা ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সুবিধা পেয়ে সরকার গঠন করল, তারাই কিনা পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় সরকারসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল করে দিল। তারা যুক্তি দিল, সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এটা পরিহাসের যে সংবিধান সংশোধনীর জন্য গঠিত একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হলো। অথচ এই বিশেষ কমিটি ২৯ মার্চ ২০১৩ তাদের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখেছিল। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যৎ সাপেক্ষে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, দশম সংসদ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয়) এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় হতে পারে।
নির্বাচনকালীন প্রশাসন নিয়ে উদ্ভূত চলতি সংকটের অবসান জরুরি। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে একটি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হতে হবে। সরকার এবং সংসদের সব বিরোধী দলের মধ্যে একটি অর্থবহ সমঝোতা প্রতিষ্ঠা দরকার। ইতিমধ্যে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। যেকোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ নির্বাহী কর্তৃত্ব রয়েছে। কী ধরনের সমঝোতায় পৌঁছা দরকার, সে বিষয়ে জনমত জরিপগুলোতে তার সাধারণ প্রতিফলনও রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট যে সবার অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে যদি কোনো একতরফা নির্বাচন হয়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না। দেশটিকে খাদের কিনারায় না ঠেলে দিতে আমাদের এখনো সুযোগ রয়েছে। আমাদের জনগণের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করুন এবং অন্য সব ধরনের দলীয় উদ্বেগ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিন।
ড. কামাল হোসেন: সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।