ফ্রান্সে কেন এত হামলা?

ফ্রান্সের নিস শহরে বাস্তিল দিবস উদ্‌যাপনের সময় মোহাম্মদ লাওয়েজ বুলেল নামের যে ব্যক্তি ৮৪ জন  মানুষকে মেরে ফেললেন, তিনি কি ইসলামিক স্টেটের প্রতিনিধি ছিলেন, নাকি তাদের নাম ব্যবহার করে এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন—সেটা বড় প্রশ্ন নয়। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক মৌলিক প্রশ্নের অবতারণা হয়: ফ্রান্সে কেন এত বড় বড় হামলা হয়, কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশে তা হয় না কেন?

সম্প্রতি বেলজিয়ামেও হামলা হয়েছে, কিন্তু সেখানে এত ঘন ঘন তা হয় না। আর গত এক দশকে ব্রিটেন বা স্পেনে কোনো সন্ত্রাসী হামলায় ১০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়নি। জার্মানিতে তো এত বড় হামলাই হয়নি। ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যর্থতাকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ, ইউরোপজুড়েই যোগাযোগের সমস্যার কারণে গোয়েন্দা তৎপরতা ব্যর্থ হয়। উত্তরটা অন্য কোথাও রয়েছে। বিষয়টা হচ্ছে জিহাদের প্রসঙ্গ এলে ফরাসি ব্যতিক্রম বলে একটা ব্যাপার সামনে চলে আসে।

আসলে ফরাসি বিপ্লবের পর ফরাসি জাতি নিজেদের যে আদর্শে বলীয়ান করেছে, তার মধ্যেই এই ব্যতিক্রমের বীজ রয়েছে, অংশত। এই আদর্শের একটি দিক হচ্ছে খুব দৃঢ়প্রত্যয়ী প্রজাতন্ত্রবাদ ও সব ধর্মের প্রতি উন্মুক্ত অবিশ্বাস, যা শুরু হয়েছিল ক্যাথলিক ধর্মকে দিয়ে। এই মডেলটি বছরের পর বছর ধরে নানা কিছুর সংস্পর্শে এসেছে। প্রথমত, এটি বিঔপনিবেশিকীকরণের খপ্পরে পড়েছে, এরপর এসেছে বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক দুর্ভোগ, সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে ক্রমবর্ধমান হারে কলঙ্কিত করার প্রবণতা, নতুন প্রজন্মের ঐকান্তিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও বিশ্বায়ন। এতে রাষ্ট্রের পক্ষে কিছু করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।

সর্বোপরি, ফ্রান্সে একদল মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এই সমস্যার সমাধান সে করতে পারেনি। ফ্রান্সের ব্যবস্থায় কর্মজীবীরা সুরক্ষিত হলেও কর্মহীনদের প্রতি এই ব্যবস্থা অতটা উন্মুক্ত নয়, এতে সবার মধ্যেই রাগ-ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। যে তরুণেরা সুবিধাবঞ্চিত হয়ে তেমন একটা আশার আলো দেখেন না, তাঁরা নিজেদের অনেকটা ভুক্তভোগী মনে করেন। আর জিহাদিরা এদের লক্ষ্য করেই প্রচার-প্রচারণা চালায়, হয়তো তার আগে সেই তরুণেরা ছোটখাটো অপরাধের জন্য জেল খেটে এসেছেন।

জার্মানি বা ব্রিটেনের এই প্রান্তিকীকরণের সমস্যা নেই বা থাকলেও তার মাত্রা এতটা ভয়াবহ নয়। জার্মানির ডিনস্ল্যাকেন নামের ছোট একটি ঘেটো শহর আছে, যেটি ইসলামি চরমপন্থার উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। ইংল্যান্ডের পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ডিউসবিউরি ও ব্রাসেলসের মোলেনবিক শহরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু মনে হচ্ছে, ফ্রান্স তার অনেক নাগরিক ও অধিবাসীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, যাদের সংখ্যা ইসলামি স্টেটে যোগ দেওয়া তরুণদের চেয়েও অনেক বেশি।

এর একটি কারণ হচ্ছে, ফ্রান্সের নাগরিকত্বের ধারণা খুবই উচ্চমার্গীয় কিছু মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি গত কয়েক বছরে অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। ১৯৮০-এর দশক থেকেই রিপাবলিকান আদর্শ পথভ্রষ্ট হতে শুরু করে: এটা সমসুযোগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ঠিকঠাক দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই সময়ে ফ্রান্সের গরিব মানুষের দল কমিউনিস্ট পার্টিও অনেক দুর্বল হয়ে গেছে, যার আংশিক কারণ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন।

অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে জার্মানি আরও দূরদর্শী ও সংযত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করে। আজ মুসলিম বিশ্বের প্রতি জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি যথেষ্টই সংযত। আবার তারা নিজ দেশের নাগরিকদের সর্বজনীন নীতিতে বাঁধতে চায়নি। আবার ব্রিটেনও একমুখী সংস্কৃতি নির্মাণের চেষ্টা করছে না। তারা বহু সংস্কৃতির মিলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যেখানে হাইফেনযুক্ত লম্বা পরিচয় ও সাম্প্রদায়িক আচরণ সহাবস্থান করতে পারে।

এদিকে ফ্রান্স একদম ইউনিভার্সালিস্ট অবস্থান নিয়েছে। তারা দাবি করে, সমাজে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা ও শক্তি দুটোই তার আছে। কিন্তু তার আত্তীকরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দৈনন্দিন বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়, আর এই ক্রমবর্ধমান ফারাকই সর্ব ব্যাপক দুঃখ-দুর্দশার কারণ। আর তাই ফ্রান্সের জাতীয় পরিচয়ের শক্তি ও মাহাত্ম্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে শুধু সেখানে বসবাসরত উত্তর আফ্রিকার তরুণদের হতাশাই বাড়ে। কথা হচ্ছে, ফ্রান্স যখন আলজেরিয়া থেকে সরে আসে, তখন সে ওখানে হাজার হাজার মানুষকে মেরেছিল। তার চেয়ে বড় কথা হলো, তারা মানুষের সম্মিলিত অবচেতনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, যেটা আজও অনেকের মনে রয়ে গেছে।

হ্যাঁ, এটা ঠিক ব্রিটিশ ও জার্মানরা অভিবাসন ও ইসলামের ব্যাপারে ভীত। এসব উদ্বেগের কারণেই ব্রেক্সিট হতে যাচ্ছে। জার্মানির কোলনে নববর্ষ উদ্‌যাপনের সময় আপাতদৃষ্টিতে অভিবাসীদের দ্বারা যৌন নিপীড়ন জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশেই উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। কিন্তু জার্মানি ও ব্রিটেন উভয়েই অভিবাসী সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত রীতি প্রকাশ্যেই পালন করার সুযোগ দিয়েছে।

কিন্তু ফ্রান্স রিপাবলিকানিজমের নামে দাবি করে, ধর্ম মানুষের একদমই ব্যক্তিগত ব্যাপার। চরম আদর্শবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তারা মাথায় হিজাব পরাসহ উন্মুক্ত স্থানে জামাতে নামাজ পড়ার মতো প্রথার প্রতীকী মূল্যের ওপর জোর দেয়। ফলে এসব রীতি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তার অনেক গভীর প্রভাব পড়ে। এতে ইসলামপন্থীরা অতিরঞ্জিত করার সুযোগ পেয়ে যায়, তারা তখন অভিযোগ করতে পারে, ফ্রান্স ইসলামভীতিতে আক্রান্ত। বস্তুত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তুলনায় ফ্রান্সের ইসলামভীতি বেশি, বিষয়টা এ রকম নয়। আসলে গণপরিসরে ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ইসলামের সঙ্গে অধিকতর সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

ফ্রান্স অনেক অভিবাসীকে স্থান দিয়েছে, এটা ঠিক। তার অন্তর্ভুক্তির মডেল নীতিগতভাবে অনেক উদার, কিন্তু বাস্তবে তা অনেক বেশি অনমনীয়। ফ্রান্সের সমাজের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আরও বাস্তবসম্মত ও নমনীয় মনোভঙ্গি নিতে হবে। আদর্শিক নির্দেশনা দেওয়া কমাতে হবে তাদের, আর বহুত্ববাদের সম্পর্কেও তাদের উদ্বেগ কমাতে হবে। তাহলে কিছু হতে পারে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া।

ফরহাদ খোসরোখাভার: ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক