আঁরার আজাদী

.
.

একটি দৈনিক পত্রিকার পক্ষে অর্ধশতাব্দী ধরে তার প্রকাশনা অব্যাহত রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনাও বটে। তার ওপর পত্রিকাটি যদি রাজধানী ঢাকার বাইরের কোনো অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়, তাহলে তার চলার পথ কতটা দুর্গম সহজেই অনুমেয়। এই কঠিন কাজটি ৫৬ বছর ধরে সম্পাদন করে গৌরবের অংশীদার হয়েছেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর উদ্যোক্তা ও এর সংবাদকর্মীরা। এই দীর্ঘদিন ধরে শুধু প্রকাশনা অব্যাহত রাখা নয়, পাঠকের আস্থা ও সমর্থন পেয়েও ধন্য হয়েছে দৈনিক আজাদী
আজাদী সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সমালোচনা—এটি আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই সংবাদপত্রটির যেখানে সীমাবদ্ধতা, সেখানেই তার সাফল্য। আজাদীর নীতিনির্ধারকেরা কখনো এটিকে জাতীয় দৈনিকের চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেননি, বরং একটি অঞ্চলের মানুষের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরে এর প্রতিকারের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি স্থানীয় ছোটখাটো সভা-সেমিনার, অনুষ্ঠানাদির সংবাদও এতে ছাপা হয়। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষ এটিকে নিজেদের কাগজ হিসেবে গ্রহণ করেছে। আঙ্গিক বা মুদ্রণ পরিপাট্য হয়তো প্রকাশনাশিল্পের সাম্প্রতিক উৎকর্ষের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে, অবশ্য আঙ্গিকের বড় ধরনের পরিবর্তন এর অভ্যস্ত পাঠকের কাছে গৃহীত হবে কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। এর সংবাদ-সম্পাদনার মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়, কিংবা প্রকাশিত ফিচারগুলোও অনেক সময় সুসম্পাদিত মনে হয় না, কিন্তু আপনজনের দোষ-ত্রুটি যেমন চোখে পড়ে না, তেমনি আজাদীর পাঠকও যেন এসব ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাসমেতই গ্রহণ করেছেন এই পত্রিকাটিকে।

আজাদী অনেক সময় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেও সংবাদের শিরোনাম করেছে। মনে পড়ে, চট্টগ্রামের মানুষ ড. ইউনূস যেদিন নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন, তার পরদিন আজাদী প্রধান শিরোনাম করেছিল, ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়ে।’ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু যেদিন চট্টগ্রামে আঘাত হেনেছিল তার আগের দিন আজাদীর সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘রোয়ানু আইয়ের’। এভাবে চট্টগ্রামের গৌরবের সঙ্গে যেমন এ অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে আজাদী, আবার শঙ্কা ও দুর্দিনের সময় আপনজনের মতো তাদের সতর্ক করার দায়িত্ব নিয়েছে।

১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল আজাদী। এটি চট্টগ্রামের প্রথম দৈনিক নয়, এ অঞ্চলে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের ইতিহাস দীর্ঘকালের। কিন্তু এসব পত্রিকার কোনোটিই দীর্ঘজীবী হয়নি। এমনকি ‘দৈনিকে’র তকমা থাকলেও এ পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা নিয়মিত ছিল না, কালেভদ্রে প্রকাশিত হতো এবং অনিবার্য নিয়মে একসময় বন্ধ হয়ে যেত।

দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী আবদুল খালেক মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামের মুদ্রণশিল্পের পথিকৃৎও বলা যায় তাঁকে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস’ থেকে প্রকাশিত হতো বিভিন্ন সংবাদপত্র। এসব স্বল্পজীবী পত্রিকার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। ব্যর্থতার কারণও শনাক্ত করেছিলেন। সেই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রকাশ করেছিলেন আজাদী

সে সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলো চট্টগ্রাম বা অন্যান্য জেলা শহরে পৌঁছাত এক দিন পরে। এ কারণে দিনের সংবাদ দিনে প্রকাশ করে পাঠকের তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পেয়েছিল আজাদী। তবে এই কাগজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ের পর। এই ঘূর্ণিঝড় দেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রামকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল চট্টগ্রাম। এ সময় ঢাকা থেকে দৈনিক পত্রিকা আসা কয়েক দিন বন্ধ থাকে। সেই দুর্যোগের দিনগুলোতে আজাদীর সাংবাদিক-কর্মচারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, এমনকি বিদ্যুতের পরিবর্তে কায়িক শ্রমে মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা চালু রাখেন। জেলার ধ্বংসযজ্ঞের মর্মস্পর্শী খবর তখন চট্টগ্রামবাসী পেয়েছিল এই পত্রিকার মাধ্যমে। তখন থেকেই আজাদীর ওপর নির্ভরতা বাড়ে, চট্টগ্রামবাসীর জনপ্রিয় মুখপত্র হয়ে ওঠে এই পত্রিকা।

মাত্র দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল খালেক মৃত্যুবরণ করলে আজাদীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। পরিচালনা সম্পাদক হন ছেলে এম এ মালেক। মোহাম্মদ খালেদ সূচনালগ্ন থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সে সময়কার মুসলিম লীগের প্রবল প্রতাপশালী নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন তিনি। মোহাম্মদ খালেদ ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এম এ মালেক পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে তিনি কাগজের স্পোর্টস রিপোর্টিং, আলোকচিত্রী ও ছোটদের পাতা ‘আগামীদের আসর’ পরিচালনাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। এখনো তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক এবং তাঁর ছেলে ওয়াহিদ মালেক এর পরিচালনা সম্পাদক।

স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক আজাদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে এ দেশের সব দৈনিক পত্রিকায় কিছু প্রবন্ধ সরবরাহ করে তা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। দৈনিক আজাদী তা প্রকাশ করলেও পরদিন তার জবাবে বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রবন্ধ ছাপে। এ কারণে তখন সরকারি গোয়েন্দা রিপোর্টে আজাদী সম্পর্কে বলা হয়, ‘A Bengali Daily from Chittagong having leaning towards opposition.’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে চলে গেলে আজাদীর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে
যায়। নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদসহ কয়েকজন সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশত্যাগ করেন।

প্রায় তিন মাস প্রকাশনা বন্ধ থাকার পর তৎকালীন মুখ্য প্রতিবেদক ওবায়দুল হক পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নেন। ভয়ভীতি ও হুমকির মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজন সাংবাদিক তখন এ পত্রিকার প্রকাশনা চালিয়ে যান। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ পরদিন ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদীতে। ওই দিন এ দেশে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। সেদিক থেকে বলা যায়, আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।

বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তখনকার একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের শ্রম-নিষ্ঠা ও ভালোবাসায় আজ দৈনিক আজাদী এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দীর্ঘ পথচলায় পেয়েছে চট্টগ্রামের পাঠকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আজ আজাদীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ধরন পাল্টেছে। মুদ্রণশিল্পেও ঘটেছে বিপ্লব। রেডিও, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন মিডিয়াগুলোর সঙ্গে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছে সংবাদপত্র। এই বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে যত দিন চট্টগ্রামের পাঠকের কাছে এই প্রাচীন দৈনিকটি ‘আঁরার আজাদী’ হিসেবে আদৃত হবে, তত দিন আজাদী বেঁচে থাকবে মাথা উঁচু করে।

 বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।