যে শহর গত শতকে বিপুল পরিমাণে অভিবাসী ও শরণার্থী গ্রহণ করেছে, সেই শহরে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যদেশ গত সোমবার আলোচনা করল, বিশ্বের দরিদ্র ও ক্লান্ত মানুষদের নিয়ে কী করা যায়। যারা দল বেঁধে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছে, যাদের আকাঙ্ক্ষা মুক্ত হওয়ার, এ কথাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে লেখা আছে। সেদিন ঠিক হলো, আরও দুই বছর এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। কিন্তু কিছু ইউরোপীয় দেশ স্ট্যাচু অব লিবার্টির এই ঘোষণা অস্বীকার করছে। এই লাখ লাখ ঘরছাড়া মানুষকে গ্রহণ না করার জন্য সবই তারা করছে, ঝোড়ো বাতাস যাদের উড়িয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ফেরত পাঠানো হয়েছে তাঁদের। তুরস্ককে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে স্রেফ একটা কারণে, যাতে শরণার্থীরা ইউরোপ অভিমুখে যেতে না পারে।
জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী শুধু ২০১৫ সালেই সাড়ে ছয় কোটি মানুষকে বলপূর্বক বাস্তুত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ ছিল শরণার্থী, ৩০ লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশী এবং ৪ কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তাঁর আমলের শেষ সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। সোমবারের এই গণ-অভিবাসনবিষয়ক ঘোষণায় তিনি আশার আলো ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই অধিবেশন মানুষের চলাচল–বিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক বড় সাফল্য। আমরা যখন নিউইয়র্ক ঘোষণা বাস্তবায়ন করব, তখন অনেক বেশি শিশু স্কুলে যেতে পারবে, অনেক শ্রমিক নিরাপদভাবে চাকরি খুঁজতে পারবে। তখন আর তাঁদের মানব পাচারকারীদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। আরও বেশি মানুষের হাতে সুযোগ থাকবে, যুদ্ধ শেষ হলে তারা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে, নাকি নিজ দেশেই শান্তি বজায় রাখবে ও সুযোগ বাড়াবে।’ তবে জাতিসংঘ শেষমেশ রাজনৈতিক চাপে না বাজে প্রচারণার জন্য এই বিপর্যয় সামাল দিতে রাজি হলো, তা পরিষ্কার নয়।
এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ২০১৬ সালটাও অভিবাসনের বছর হতে যাচ্ছে। ইতালীয় উপকূলরক্ষীরা একবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভূমধ্যসাগরে ৪০টি অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৫০০ মানুষকে উদ্ধার করেছে। আর এবার এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২১২ জন নৌকাডুবিতে মারা গেছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ নিয়ে তেমন একটা গরজ দেখাচ্ছে না। তাঁদের প্রতিক্রিয়া খুবই ধীরগতির। জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনার জিদ রাদ আল হুসেইন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই গা-ছাড়া মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিক্ত সত্যটা হচ্ছে, এই সম্মেলন আয়োজনের কারণ হচ্ছে, আমরা মূলত ব্যর্থ হয়েছি।’ উল্লিখিত ঘোষণাটি গৃহীত হওয়ার ২০ মিনিট পর তিনি ফ্লোরে প্রবেশ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই লাখ লাখ অভিবাসীকে আমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শুধু অসম্মান ছাড়া কিছু দিতে পারছি না। যারা এমন ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হয়ে ঘরছাড়া হলো, তাদের আমরা আরও কষ্টের দিকে ঠেলে দিলাম। আমরা তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি, ব্যাপারটা লজ্জাজনক।’ তাঁর এ কথা উপস্থিত নেতাদের ব্যাপক প্রশংসা পায়।
হাইকমিশনের ইউএনস হিউম্যান রাইটস অফিস এই ঘোষণা–সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে তাদের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই নথিতে ‘কিছু গুরুতর’ চিন্তার জায়গা রয়েছে, যেমন নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে শিশুদের আটক রাখা।
এখন কথা হচ্ছে, শরণার্থী সংকটের কারণ একটি নয়, একাধিক। সিরিয়ায় যুদ্ধের কারণে শরণার্থীদের যেমন রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তেমনি দক্ষিণ সুদান ও আফগানিস্তানের মতো দেশের অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও সারা বিশ্বে শরণার্থীদের স্রোত আরও তীব্র হচ্ছে। ওদিকে দলবদ্ধ সহিংসতা ও মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালা থেকে মানুষ উত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে।
অধিকারভিত্তিক সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, সোমবারের এই ঘোষণা পূর্ণাঙ্গ নয়, এতে আরও কিছু থাকা দরকার ছিল। জাতিসংঘের ডিরেক্টর অব হিউম্যান রাইটস লুইস চারবনিউ বলেছেন, ‘সাহায্যের যত আবেদন করা হয়েছে, তাতে অর্থ দেওয়া হয়েছে খুবই কম।’ বান কি মুন এক ‘উচ্চাভিলাষী ও যৌক্তিক পরিকল্পনা’ করেছিলেন, সেটা হলো, প্রতিবছর বিশ্বের ১০ শতাংশ শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু সদস্যরাষ্ট্রগুলো এ পরিকল্পনা বাতিল করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে এই ঘোষণাকে ‘হারিয়ে যাওয়া সুযোগ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলো ঘোষণার ভাষায় তেমন একটা খুশি হতে পারেনি। ৬০টি গোষ্ঠীর একটি জোটও এনজিওগুলোর সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘অসম অঙ্গীকার ও নতুন চুক্তির ব্যাপারে গরজ না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
সিরিয়া রিলিফ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের আউটরিচ ম্যানেজার মাইস বালখি বলেছেন, জাতিসংঘের এই মনোভঙ্গিটা অরাজনৈতিক, তাতে ভয়ের ছাপ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত সিরিয়ার অধিবাসী ও বাস্তুচ্যুত মানুষ যাঁরা দেশেই আছেন, তাঁদের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে।
মাইস বালখি বলেন, ‘তারা রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে মানবিক বিষয় জড়াতে চায় না।’ তাঁর সংগঠন চায়, রাষ্ট্র ও স্থানীয় সমাজ শরণার্থীদের পুনর্বাসন কাজে অংশ নিক। তিনি আরও বলেন, যেসব সদস্যরাষ্ট্রের শরণার্থীসংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের উচিত হবে, যারা প্রথম প্রথম এই সংকট মোকাবিলা করছে, তাদের সহায়তা করা। এখন দেখতে হবে, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো কোন ঐকমত্যে আসে এবং ২০১৮ সালে তারা কী বাস্তবায়ন করে। আর এতে দেশগুলো কেমন সাড়াই-বা দেয়।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।
ডি পারভাজ: আল-জাজিরা ইংলিশের মানবাধিকার–বিষয়ক সিনিয়র প্রোডিউসার।