ফারাক্কার তিন অভিশাপ

ভারতের বিহার প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে সম্প্রতি যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, ৫০ বছর আগে তার হুঁশিয়ারি করেছিলেন এক বাঙালি নদী-প্রকৌশলী। সম্প্রতি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার তাঁর রাজ্যের বন্যাদুর্গতির জন্য দায়ী করেছেন পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত ফারাক্কা ব্যারাজকে। তিনি দিল্লির কাছে এই বাঁধ অপসারণের দাবিও জানিয়েছেন। আর সেই ১৯৬২ সালেই পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও জলপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কার তিনটি অভিশাপের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে আমার হুঁশিয়ারি না মানার পরিণতিতে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, এই বাঁধ নদীর পলি-ভরাট হওয়া আরও বাড়াবে, ভাটির দেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ কমাবে এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ 

আর বিহারের বেশ কটি জেলায় বন্যার প্রকোপ বাড়াবে।

>নদীর তাজা পানিকে সরাসরি সমুদ্রে পড়তে না দিলে তা ভারতের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহেরও ক্ষতি করবে। তাতে করে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ পানির কষ্টে ভুগবে

তাঁর তিন হুঁশিয়ারিই যে ফলে গেছে, তা আজ সর্বজনবিদিত। সে সময় ফারাক্কার বিরোধিতার জন্য ভারতীয় গণমাধ্যম তাঁকে পাকিস্তানের চর বলেছিল এবং পরিণামে সরকারি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এই নদীবিশেষজ্ঞ। আমৃত্যু তিনি তাঁর মতে অটল থেকেছেন এবং নিজের ভবিষ্যদ্বাণী নিজেই ঘটে যেতে দেখেছেন।

বাংলাদেশের বেলায় ফারাক্কা ব্যারাজের অভিশাপ আরও বহুদিকে ছড়িয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়; ঘটনা এটুকুই নয়। পানিপ্রবাহ না থাকায় উত্তরবঙ্গের বিরাট এলাকা মরুকরণের দিকে যাচ্ছে, অনেক
নদী মরে গেছে ও যাচ্ছে এবং সেচের জন্য বিপুল ব্যয় হচ্ছে কৃষকের, মৎস্যজীবী অথবা পানির ওপর নির্ভরশীল লাখো মানুষ পেশা হারাচ্ছে ইত্যাদি। ফারাক্কার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আরও কিছু অভিশাপের দিকও আলোচনায় আসা দরকার।

জনসংখ্যার ১২ শতাংশের আর্সেনিক–ঝুঁকি

গত ২৪ জুন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংসদে জানান, দেশের ১২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিক বা সেঁকো বিষের দূষণের ঝুঁকির মুখে আছে (প্রথম আলো, ২৫ জুন ২০১৬)। এই হিসাব ২০১৩ সালের। বিপদের মাত্রা এখন আরও বেড়েছে বৈ কমেনি। জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ কমবেশি আর্সেনিকের হুমকিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে ‘জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিষক্রিয়া’র ঘটনা বলে বর্ণনা করে। গঙ্গা নদীব্যবস্থার পানিপ্রবাহ ফারাক্কার আগের স্তরে নিয়ে গেলে এর সমাধান হতে পারে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত দুই বিশেষজ্ঞ—থমাস ই ব্রিজ ও মির টি হোসেইন। তাঁদের গবেষণার শিরোনাম ‘গ্রাউন্ডওয়াটার আর্সেনিক পয়জনিং অ্যান্ড এ সলিউশন টু দ্য আর্সেনিক ডিজাস্টার ইন বাংলাদেশ’। তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে কন্টামিন্যাটেড সয়েলস, সেডিমেন্টস অ্যান্ড ওয়াটার, ভলিউম ১০ বইয়ে, ২০০৬ সালে। গবেষক দুজনের যুক্তি হলো, ভারত এককভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশকে ব্যাপক মাত্রায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচকাজ চালাতে হয়। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে তো নামছেই। এর প্রতিক্রিয়ায় আর্সেনিকবাহী খনিজের অক্সিডাইজেশন ঘটে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ঘটে। তাঁদের মতে, আর্সেনিক সমস্যা মেটাতে হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার আন্তসীমান্ত নদীগুলো, বিশেষত গঙ্গা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে নিয়ে যেতে হবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার আগের পর্যায়ে।

নদীর পানিপ্রবাহকে অবাধ রাখার পক্ষে ভারতের পানিনীতি বিশেষজ্ঞ, পানি আইন সংস্কার কমিটি ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য মিহির শাহও। দ্য হিন্দু পত্রিকায় গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নদীর তাজা পানিকে সরাসরি সমুদ্রে পড়তে না দিলে তা ভারতের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহেরও ক্ষতি করবে। তাতে করে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ পানির কষ্টে ভুগবে। ভারতের চলমান আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের বিপদটাও এখানেই।প্রকৃতির সঙ্গে কূটনীতি ও চাতুরীর সুযোগ নেই।

ভবদহ জলাবদ্ধতা

খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কখনো বছরের পুরোটা, কখনো ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকার নাম ভবদহ জলাবদ্ধতা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমানে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক মনে করেন, ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবাহিত গড়াই নদের পানি কমে যায়। একদিকে নদে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়তে থাকে, অন্যদিকে উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহের চাপ কমে যাওয়ায় জোয়ারের লোনা পানি ঠেলে উজানের দিকে আসতে থাকে। আসতে আসতে নদের বুক কেটে আনা পলি জমতে থাকে ওপরের দিকে, ষাটের দশকে নির্মিত পোল্ডার, বাঁধ ও সেতুগুলোর আশপাশে। এভাবে কপোতাক্ষসহ আশপাশের কোদলা, বেতনা, চিত্রা, নবগঙ্গা, বেগবতী, মুক্তেশ্বরী, হরিহর, ভদ্রা, শ্রী ইত্যাদি নদীর মৃত্যু ঘটে। পলি জমে নদীবক্ষ ভরাট হয় এবং অকার্যকর হয় পানিনিষ্কাশনের স্লুইসগেটগুলো। এলাকাটি স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয় (প্রথম আলো, ৪ জুলাই ২০১২)। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনেও ভবদহ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে ফারাক্কাকে দায়ী করা হয়।

এবারও এখানকার তিন উপজেলার প্রায় কয়েক লাখ মানুষের ঘরদোর, আবাদ-ঘের সব পানিতে তলিয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ আগের হিসাবেই পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে মারা গেছে ১২ জন। গত বছর সরেজমিনে এই এলাকার এক করুণ কাহিনি শুনি মানুষের মুখে। ঘরদোরে পানি উঠে গেলে লোকে ঘরের ভেতর বা বাইরে মাচা বানিয়ে বাস করে। এ সময় সাপ থেকে বাঁচতে কিংবা মাছ মারতে তারা লোহার কোঁচা সঙ্গে রাখে। সাড়ে তিন বছরের শিশুসন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল একটি পরিবার। হঠাৎ পানিতে খলবল শব্দে অন্ধকারে উঠে বসেন বাবা মানুষটি।  বড় মাছ মনে করে শব্দের উৎসের দিকে কোঁচাটা ছুড়ে মারেন। কিন্তু মাছ নয়, চিৎকার করে ওঠে তাঁর সাড়ে তিন বছরের শিশুটি। ঘুমের ঘোরে শিশুটি পানিতে পড়ে গিয়েছিল!  দুর্যোগের অভিশাপে বাবার হাতে খুন হয়ে গেল অবুঝ শিশুটি।

১৯৪১-৪২ সালের কুখ্যাত দুর্ভিক্ষের সময়ও এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভাব হয়নি। বরাবরই এটা ছিল খাদ্য-উদ্বৃত্ত এলাকা। জলাবদ্ধতার কারণে এখন সেখানে ফসল মার যায়, জীবন যায়, লোকে দেশান্তরি হয়।  অবস্থাকে আরও করুণ করে তোলে ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত নির্মিত বিভিন্ন ধরনের বাঁধ, পোল্ডার ও স্লুইসগেট। উন্নয়নের নামে দেশি-বিদেশি পানিশাসন–ব্যবস্থার মাশুল দিচ্ছে সেসব মানুষ, যারা এর জন্য দায়ী নয়। আর যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহি করার ক্ষমতা দুর্গত মানুষের নেই।

সুন্দরবন ও দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য গড়ে উঠেছিল নদীর মিঠা পানির প্রবাহ এবং সামুদ্রিক জোয়ারের লোনা পানির আসা-যাওয়ার ছন্দে। কিন্তু ভারত যেদিন থেকে (১৯৭৪-৭৫) গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু করল, সেদিন থেকেই সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে লোনা পানির উজান ঠেলে আসা শুরু হলো। মো. মাহমুদুজ্জামান, জহির উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম নুরুজ্জামান ও ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদের ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ট রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে দাবি করা হয়, গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কারণেই সুন্দরবনসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদী, ভূমি ও বন লবণাক্ততার শিকার হয়েছে। এটা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকেও হুমকিতে ফেলেছে। এই দক্ষিণাঞ্চল তথা পটুয়াখালী থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত অঞ্চল একসময় ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল কৃষি এলাকা। কিন্তু এখন সেখানে ফসল বিপর্যয় নিয়মিত ঘটনা। ফারাক্কার কারণে উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো পলিবহনের বদলে পলিতেই ভরাট হচ্ছে। আর এটা প্রভাব ফেলছে সুন্দরবনের গাছ, প্রাণী-পতঙ্গ, জলজ জীবসহ সব প্রাণের বাস্তুসংস্থানে। সুন্দরবনের ভেতরেই লবণাক্ততার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব পড়ছে বনের বাস্তুসংস্থানে। অথচ এখানেই বসবাস করে বিপন্ন প্রজাতির সুন্দরীগাছ, বিপন্ন প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন ও কুমির। সম্প্রতি সুন্দরবনের বিষয়ে ইউনেসকোর প্রতিবেদনেও সুন্দরবনের লবণাক্ততার জন্য ফারাক্কা ব্যারাজকেই দায়ী করা হয়।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফারাক্কা থেকে উপকূল রক্ষাবাঁধ হয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবখানেই উন্নয়নের দোহাই। কিন্তু মাটি, মানুষ ও পানির ক্ষতি করে যে উন্নয়ন, তাতে ব্যবসা হলেও জীবন বাঁচবে না।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক  লেখক