বালু ব্যবসা বনাম জমির লড়াই

যুগ যুগ ধরে ইমারত নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বালু সনাতন নৌকাপদ্ধতিতে উত্তোলন (নৌকায় করে চরের বালু তোলা) করা হয়েছে, যা ব্রহ্মপুত্রের ভাঙা-গড়ায় প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু ২০১০ সালে স্থানীয় সাংসদের এক আত্মীয় ব্রহ্মপুত্র খননের নামে ব্যাঙমারা ঘাটের কিনারের কাছেই ড্রেজার বসিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসার মুখ খুলে দেন। প্রথমত, কোনো এলাকা সরকারিভাবে বালুমহাল ঘোষণা করা না হলে এভাবে বালু তোলা অবৈধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান বালু উত্তোলন সম্পর্কে বলেন, এটা প্রশাসনের ব্যাপার। তবে যতটুকু জানি, রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসককে চিলমারী পয়েন্টটিকে বালুমহাল হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে নির্দেশের আগেই নদীর ক্ষতি করে বালু ব্যবসার দায় কে নেবে?
দ্বিতীয়ত, নদীখনন করার কর্তৃপক্ষ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কোনো বালু ব্যবসায়ী নন। ফলে ঘাটে গভীর গর্ত সৃষ্টি হয় এবং পরের বছরের বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নেমে এসে ব্যাঙমারা ঘাট, ব্যাপারীপাড়া, রমনা ঘাট, সোনারিপাড়া, টোন গ্রাম, মাঝিপাড়া, বাসন্তীর গ্রাম ও পুরোনো জোড়গাছ বাজার ভাঙনের মুখে পড়ে। এই ভাঙনের পরও দুটি ড্রেজার যুক্ত হয়। তারপর স্থানীয় গণকমিটির নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের পর পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রক্ষায় এগিয়ে আসে। ডান তীর রক্ষা প্রকল্পের কাজে বালু সরবরাহের অছিলায় আরও কয়েকটি বাণিজ্যিক ড্রেজার যুক্ত হয়। অথচ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পার্শ্ববর্তী উজানে বৈরাগীর ভিটা ও রাজার ভিটায় প্রকল্পের কাজে বালু সনাতন নৌকাপদ্ধতিতেই সংগ্রহ করা হয়েছিল। বর্তমানে ড্রেজারের সংখ্যা শুধু রমনা ঘাটেই ১৫টি ছাড়িয়েছে। নদের তীরে জমে উঠেছে বালুর পাহাড়, যা ট্রাকে করে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্বত্র। এই বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করার জেরে সেখানে হাঙ্গামাও হয়েছে।

গঙ্গা আটকে গেছে ফারাক্কায়, কিন্তু ব্রহ্মপুত্র এখনো জিন্দা আছে। এই মহানদ প্রতিবছর ৭৫ মিলিয়ন পলি চা-বাগানময় পর্বতমালা থেকে সমতল বাংলাদেশে নিয়ে আসে। তার অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ ফেলে যায় কুড়িগ্রামে। বিজ্ঞানীরা এই এক ভাগকে বলেন ‘কালো সোনা’। এই কালো সোনা স্থানীয় বাজারে প্রতি টন ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এর প্রতি টনে আছে কাচ তৈরির সর্বোচ্চ পরিমাণ কোয়ার্টজ সিলিকা ৫০ কেজি, ইলমিটাইট ৬০০ গ্রাম, জিরকন ৪০০ গ্রাম, রুটাইল ৪০০ গ্রাম, গার্নেট ২ কেজি ৫০০ গ্রাম ও মোনাজাইট ১০০ গ্রাম, যার চলতি বাজারমূল্য ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৯২ টাকা। শিল্পায়ন না করেও যদি শুধু রপ্তানিও করা যায়, তাহলে এ থেকে বছরে আসবে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর শিল্পায়ন হলে শুধু কুড়িগ্রামই নয়, বাংলাদেশও পৌঁছে যাবে অন্য উচ্চতায়। তাই ১৯৭৮ সালেই চীন ও অস্ট্রেলিয়ার দিক থেকে বালু আমদানির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর ব্রহ্মপুত্রের বালু উত্তোলনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রেখেছে।

>কৃষক সমাজের প্রথম ও প্রধান মূল্যবোধ হচ্ছে জমি। এই জমি শুধু তার খাবার জোগায় না, তাকে দেয় তার মর্যাদাও। আর মানুষ তো মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়

নদী আর মৎস্যকেন্দ্রিক অর্থনীতি বিলুপ্তির ফলাফল একটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম: ‘অপুষ্টিতে বেঁটে হচ্ছে চিলমারীর মানুষ’। সেখানে এশিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘নিউট্রিশনাল স্ট্যাটাস, ডায়েটারি ফুড অ্যান্ড নিউট্রিয়েন্ট কনজাম্পশন প্যাটার্নস ইন মঙ্গা অ্যাফেক্টেড এরিয়া অব দ্য নর্দার্ন পার্ট অব বাংলাদেশ’ এর বরাতে বলা হয়: চিলমারী অঞ্চলের পাঁচ বছর বয়সী শিশুর ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ আর ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ৩৫ শতাংশই খর্বকায়। এ ছাড়া ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে কম। অর্ধেকের বেশি কিশোর-কিশোরীর রয়েছে শক্তির ঘাটতি। নারীদের ৬৬ শতাংশ ও পুরুষদের ৩৮ শতাংশের শক্তির ঘাটতি রয়েছে। এই চিত্র জাতীয় গড় থেকে অনেক বেশি। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, সারা দেশের মানুষজন যখন গড়ে ১২ কেজি করে মাছ খেত, তখন এই অঞ্চলের মানুষ খায় সাড়ে ৭ কেজি। অথচ কুড়িগ্রাম জেলায় ১৭-১৮টি নদনদী বন-পাহাড়-প্রান্তর পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে তারা সঙ্গে নিয়ে আসে প্রাণের সম্ভার। তার মোহনায় মোহনায় ছিল পাখপাখালি, মাছ-কাছিম-কাঁকড়ার মেলা; যা অঞ্চলের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করত। কিন্তু আরও আরও কারণের পাশাপাশি এই ড্রেজারগুলোর বিকট শব্দে বালু তোলার কারণে কাশবন আর বালুর আস্তরণে লুকিয়ে থাকা প্রাণবৈচিত্র্যের আবাসস্থল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পুষ্টিতে ভরপুর একটি জনপদ চোখের সামনে পুষ্টিহীনতার উদাহরণ হয়ে যাচ্ছে!
যুগ যুগ ধরে ব্রহ্মপুত্র পূর্ব বাংলা ও আসামের রাজপথ ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য মহানদের মতো এটি ব্যাপক প্রশস্ত। কিন্তু এই চরিত্র বজায় রাখার জন্য বিশাল উদ্যোগ দরকার। কিন্তু বালুদস্যুদের ড্রেজারগুলো ব্রহ্মপুত্রকে ধ্বংসাত্মক করে তুলছে। গণ-আন্দোলনের চাপে ডান তীর রক্ষা প্রকল্প এই অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার বোধ যেমন জাগিয়েছে, তেমনি নতুন নতুন চর জাগায় ভাতের আশাও জেগেছে। কিন্তু ড্রেজার-মালিকেরা কুড়িগ্রামের চরের পর চর খেয়ে ফেলছে, হুমকির মুখে ফেলছে ডান তীর রক্ষা প্রকল্পকে। তাই চরের মানুষ ও কাইমের (মূল ভূখণ্ড) মানুষ বেআইনি বালুখেকোদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। ভূমিপুত্ররা জানেন, বালুদস্যুদের পেছনে আছে ক্ষমতার ছায়া। কিন্তু প্রশ্নটা জমির ও বেঁচে থাকার। কৃষক সমাজের প্রথম ও প্রধান মূল্যবোধ হচ্ছে জমি। এই জমি শুধু তার খাবার জোগায় না, তাকে দেয় তার মর্যাদাও। আর মানুষ তো মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়।
নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]