সুন্দরবন বিনাশ মানবে না কেউ

.
.

শিক্ষক হিসেবে আরও অনেকের মতো এ রকম ছাত্রছাত্রীর অভিজ্ঞতা আমারও আছে—অনেক ক্লাস নেওয়ার পরও যাদের কথা শুনে বা পরীক্ষার খাতা দেখে হতভম্ব হয়ে ভাবি, কী ক্লাস নিলাম এত দিন? বোঝা যায় ক্লাসের সময় তার মন অন্য কোথাও ছিল। হয়তো অমনোযোগী, হয়তো এসব পড়ায় মন বসাতে পারে না, হয়তো এ বিষয়টাই ভালো লাগে না বা হয়তো ফাঁকি দিতে আনন্দ পায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখি, চেষ্টা করলে, শ্রম দিলে এ রকম শিক্ষার্থীর মনের টানও ঠিক করা সম্ভব, দেখেছি একই শিক্ষার্থী পরে আনন্দ নিয়ে পড়ছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা জায়গায় এসে সত্যি নাচার হয়ে যাই। কেউ যদি বুঝতে না চায়, যদি পণ করে কোনোভাবেই বুঝবে না, না বোঝায় যদি তার স্বার্থ থাকে, কিংবা যদি কারও কাছে মাথা বন্ধক দেওয়া থাকে যাতে মাথায় পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছু ঢোকানো সম্ভব না, তাহলে তাকে নিয়ে কী করা যায়?

সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকার, কোম্পানির ভাড়াটে প্রচারক বাহিনী আর অন্ধ স্তাবকদের এই দশা। হাজার বার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করলেও তারা একই কথাই বলতে থাকে। কারণটা মুহিত সাহেবের কথা থেকেই হয়তো স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘ÿক্ষতি হবে, তবুও এটা আমাদের করতেই হবে।’ কেন করতে হবে? যে ক্ষতি অপূরণীয়, যে ক্ষতি শুধু সুন্দরবনকে শেষ করবে না, পুরো দেশকে অরক্ষিত করবে, যে ক্ষতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট করবে, তাদের বানাবে পরিবেশগত উদ্বাস্তু, যে ক্ষতি প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় চার কোটি মানুষকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে, সেই কাজ সরকারকে কেন করতেই হবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে এ রকম জনধ্বংসী বন-নদীবিনাশী প্রকল্প মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মানবে কেন?

মানে না, মানবে না বলেই এই মহাপ্রাণের বিপদে জেগে উঠেছে সর্বস্তরের মানুষ। শুধু দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরে প্রবাসে যাঁরা আছেন তাঁরাও এখন সোচ্চার। যার যা আছে তা-ই নিয়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে জানা-অজানা অসংখ্য মানুষ। শিশুরা ছবি আঁকছে, গান গাইছে, ছবি আঁকছে তরুণ শিল্পীরা, নতুন নাটক তৈরি হচ্ছে, নাট্যকর্মীরা নাটক নিয়ে ঘুরছে পথে পথে, গানের শিল্পীরা নতুন নতুন গান লিখছে, সুর দিচ্ছে, নতুন শিল্পীও তৈরি হচ্ছে, ভিডিও বার্তা আসছে, তথ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে, লেখক-বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন, নতুন বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। আর মিছিল, সভা-সমাবেশ তো আছেই। এ এক অভূতপূর্ব জোয়ার। প্রাণের টানে, যুক্তির জোরে, নৈতিকতার সাহসে, তারুণ্যের জোয়ারে তৈরি হচ্ছে একের পর এক ডাক।

অনেক দামে কেনা কোম্পানিমুখী প্রচারকদের প্রচারণার জবাবে কত তরুণ যে কতভাবে শ্রম ও সময় দিচ্ছে, তার সংখ্যাও আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এসব তৎপরতায় যারা নিয়োজিত তাদের কেউ নিয়োগ দেয়নি, তাদের কাজের সময় কেউ বেঁধে দিতে পারে না, তাদের খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমানোর ঠিক নেই। এদের প্রায় সবাই তরুণ। প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যক্তির নীরবতা, ভীরুতা এখন দৃষ্টিকটু; সুবিধার সন্ধান করতে গিয়ে হয়তো দাসত্বের জোয়াল তাদের ঘাড়ে, এই তরুণেরা তার থেকে মুক্ত। এরাই সুন্দরবন আন্দোলনের মূল শক্তি।

সরকার আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, এতসব আন্দোলনের টাকা কোথা থেকে আসে? করুণা হয় এসব প্রশ্নকারীর জন্য। তাদের মন-মনোযোগে প্রাণবন্ত মানুষ মৃত, মুক্তিযুদ্ধ মৃত, তাদের কাছে মনে হয় সবকিছুই টাকা দিয়ে কেনা যায়, মানুষ কেবল টাকার বিনিময়েই কাজ করে। সে জন্য তাদের কাছে মানুষের প্রাণের টান, স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ, জীবন বাজি রেখে সমষ্টির জন্য লড়াই করার শক্তি অজানা। এখনই অনলাইনে ফেসবুকে সুন্দরবন বাঁচাতে যে কয়টা ভিডিও তথ্যচিত্র ঘুরছে, যে কয়টি গান ঘুরছে—এগুলো যদি সরকার বা কোনো কোম্পানি বানাতে চাইত তাহলে কয়েক কোটি টাকা দিয়েও সম্ভব হতো না। যারা এগুলো বানিয়েছে, তারা কারও নির্দেশে, ফরমাশে এগুলো বানায়নি, বানিয়েছে নিজেদের ক্ষোভ, ক্রোধে আর আনন্দের তাগিদে। তাই খেয়ে না খেয়ে, নিজেদের খাওয়ার টাকা বাঁচিয়ে, ধার করে, সবার মেহনত ও সম্বল যোগ করে এগুলো বানানো। দায়িত্ববোধ আর তারুণ্য এখানেই পাওয়া যাবে। এদের ওপর হামলা করে, আটক করে, ভয় বা লোভ দেখিয়ে জোয়ার ঠেকানো কার সাধ্য?

জাতীয় কমিটি থেকে আমরা বহুবার সরকারকে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি উপস্থাপন করে দেখিয়েছি যে, কোম্পানি যে দূষণ দূর করার কাহিনি বলছে, দুনিয়ায় তার কোনো গ্রহণযোগ্য দৃষ্টান্ত নেই। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার দরপত্র ও অন্যান্য দলিলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকেই দেখা যায় যে এতে দূষণ বিপদমুক্ত মাত্রায় দূর হবে না, অনেকাংশে স্থানান্তরিত হবে মাত্র। তা ছাড়া এগুলো ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় ও দাম বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, যে তথ্য গোপন করা হচ্ছে, এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবেও তা আর্থিকভাবে খুবই অযৌক্তিক হবে।

সরকারের তদারকির কার্যকারিতা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলে বলেছি, যেখানে সচিবালয় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে বুড়িগঙ্গা দূষণে প্রায় মৃত, সেখানে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে সরকারি তদারকি ঠিকঠাকভাবে কাজ করবে—এটা কে বিশ্বাস করবে? তেল ও কয়লার জাহাজডুবির পর সরকারের ভূমিকাও আমাদের স্মরণে আছে। জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করার পর জাহাজ চলাচল, ঘষিয়াখালী চ্যানেল জাহাজ চলাচলে উন্মুক্ত করার ঘোষণা, অর্থ বরাদ্দের পরও ওই চ্যানেল দখলদারদের হাতে আটকে থাকা—এগুলো থেকে আমরা বুঝি সরকারের প্রতিশ্রুতি ও কাজ, ঘোষণা ও বাস্তবতার দূরত্ব। তবু তাঁরা বারবার বলেছেন, ‘ক্ষতি যে হবে তার প্রমাণ কী? বৈজ্ঞানিক তথ্য–প্রমাণ দেন।’ আমরা দিয়েছি। সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা ছাড়াও দুই দফা সরকারের মন্ত্রী, আমলা, কোম্পানির কর্মকর্তা, সংসদীয় কমিটির সামনে আমাদের সব যুক্তি, তথ্য উপস্থাপন করেছি। কিন্তু তাঁরা ‘বুঝবেন না’ পণ করে বসে থাকলে কীভাবে বোঝানো সম্ভব?

এর আগেও ইউনেসকো একাধিকবার সরকারকে সতর্ক করেছে, সরকার গুরুত্ব দেয়নি। এবার ইউনেসকো টিম বাংলাদেশে এসে সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শন করে, খুব পরিষ্কার করে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং তারা সুন্দরবন বাঁচাতে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে (প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। ইউনেসকোর এই রিপোর্ট প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের সঙ্গে ইউনেসকোর বক্তব্য মিলে যায়।’ ঠিক। কীভাবে ঘটল এ ঘটনা? ইউনেসকো টিম যখন বাংলাদেশ সফর করে তখন তাদের পরিকল্পনা ছিল, দুই পক্ষের কথাই তারা শুনবে। কিন্তু সরকার নানা বাহানা সৃষ্টি করে আমাদের সঙ্গে কোনো সভা করার সময় রাখেনি। মুখোমুখি তারা আমাদের কথা শুনতে পারেনি, শুনতে পারেনি এলাকার মানুষের কথাও। এলাকায় তাদের সামনে হাজির করা হয়েছে মুখস্থ করিয়ে আনা লোকদের। আমরা সরকারকে যেমন আমাদের সবার যুক্তি–তথ্য জানিয়েছি, তেমনি জানিয়েছি ইউনেসকোকেও। ইউনেসকোও নিজেদের সূত্র দিয়ে সত্য সন্ধান করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের বক্তব্য মিলে যাওয়ার কারণ তাই খুবই স্পষ্ট—বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে দেওয়া বক্তব্যও অভিন্ন হতে বাধ্য। কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত না হলে, নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ করলে সরকারও যে একই সিদ্ধান্তে আসবে, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।

ইউনেসকোর সর্বশেষ রিপোর্টের তাগিদ থেকে পরিষ্কার বার্তা পাওয়া যাচ্ছে যে, সরকার যদি আগের মতোই এসব গুরুতর বিষয় উপেক্ষা করে তাহলে সুন্দরবন ‘বিশ্বঐতিহ্য’ তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে। বিশ্বজুড়ে বিষয়টি এভাবে উপস্থিত হবে যে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যারা প্রকৃতিপ্রদত্ত এক অসাধারণ সম্পদ ধরে রাখার যোগ্যতা রাখে না, এ দেশের মানুষের সেই সক্ষমতা বা পরিপক্বতা নেই। সুন্দরবনবিনাশী বিদ্যুৎ প্রকল্প তাই শুধু দেশকে বিপর্যস্ত করবে না, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে কলঙ্কিতও করবে। কাজেই সরকারের উচিত হবে একগুঁয়েমি ত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, বিশেষজ্ঞ মত ও ক্রমবর্ধমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে রামপাল চুক্তি বাতিলসহ সুন্দরবনবিনাশী বনগ্রাসী সব তৎপরতা বন্ধ করা। বিদ্যুৎ-সংকটের টেকসই সমাধানে আমাদের সামনে অনেক পথ আছে, দেশকে মহাবিপদে ঠেলে দিয়ে উন্নয়ন হয় না, বিদ্যুৎ-সংকটেরও সমাধান পাওয়া যায় না।

সরকারের সামনে আর কোনো পথ নেই। বিজ্ঞাপন দিয়ে, ভাড়াটে বিশেষজ্ঞ দিয়ে, দমন-পীড়ন চালিয়ে, কুৎসা আর মিথ্যাচার করে কোনো লাভ হবে না। সুন্দরবনের বিনাশ মানে দেশের বিনাশ কেউ মানবে না।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।