ডিসি সাহেবের বিদায় সংবর্ধনা!

চট্টগ্রামের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনকে স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রতিযোগিতা দেখে বিস্মিত হয়ে যখন এর কারণটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেল, শুধু চট্টগ্রামে নয়, কুমিল্লা, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় ডিসি সাহেবদের বিদায় উপলক্ষে এই ‘আদিখ্যেতা’ হয়েছে। ময়মনসিংহের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী যোগ দিয়েছেন অন্তত ৩৫টি সংবর্ধনা সভায়। রাজার পোশাক পরে, মাথায় মুকুটশোভিত হয়ে ফারুকী সিংহাসনে বসে সংবর্ধনা নিয়েছেন। ঘোড়ার গাড়িতে চেপে হাজির হয়েছেন অনুষ্ঠানস্থলে।

ডিসি সাহেবদের বিদায়কালে নগরবাসীর এ রকম ‘আপ্লুত’ হয়ে পড়া এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়ার রেওয়াজটা কিন্তু দীর্ঘদিনের নয়। এই প্রবণতা দাতা ও গ্রহীতা কারোর জন্যই শোভন বা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না।

জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কটা যে রকম, আমলাদের সঙ্গে নিশ্চয় সে রকম নয়। এই দুই ধরনের সম্পর্কের মধ্যে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য আছে। রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর দলের সমর্থকের সম্পর্ক আবেগের। কর্মী-সমর্থকেরা তাঁদের নেতাকে মাথায় নিয়ে নাচেন, আবার বিরোধীরা তাঁর মুণ্ডুপাত করেন। তাঁদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তার বিচার হয় এক অর্থে রাজপথেই। আর শেষ বিচারে নির্বাচনই (যদি তা সুষ্ঠু হয়) রাজনীতিকদের জনপ্রিয়তার মানদণ্ড। কিন্তু আমলাদের কাজের পদ্ধতি ভিন্ন। তাঁরা সরকারের নীতিমালা ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন করেন চাকরি বিধিমালার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে। ফলে আবেগে-উচ্ছ্বাসে গা ভাসালে তাঁর পদমর্যাদা বা কর্মপদ্ধতির জন্য তা সংগতিপূর্ণ হয় না।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, একজন জেলা প্রশাসক জেলার কমবেশি ৬০ থেকে ১২০টি কমিটির প্রধান। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, শিশু একাডেমী, স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্থার নেতৃত্ব জেলা প্রশাসকের কাঁধে। এর চেয়েও বিস্ময়ের বিষয়, জেলা প্রশাসকের স্ত্রীও অন্য কোনো যোগ্যতার বিবেচনা ছাড়াই জেলার মহিলা সমিতি, গার্লস গাইড, মহিলা রেড ক্রিসেন্টসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় এ ধরনের ব্যবস্থাপনা থাকতে পারে কি না, সে এক বড় প্রশ্ন।

জেলা প্রশাসকদের সংবর্ধনা দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটিকে অনৈতিক ও সরকারি আচরণবিধির লঙ্ঘন বলে মত প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া জেলা প্রশাসকদের কর্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এসব অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাকে তোষামোদ করা হয় এবং তাঁকে উপহার-উপঢৌকনও দেওয়া হয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠান আয়োজন ও আপ্যায়নের ব্যয়ভার কে বা কারা বহন করেন, তা–ও প্রশ্নসাপেক্ষ।

সংবর্ধনা দেওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে কোনো স্বার্থচিন্তা আছে কি না, এ প্রশ্ন শুরুতেই করেছিলাম। ডিসি সাহেব বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনে আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকেন। যেসব প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছ থেকে এই আর্থিক সাহায্য পেয়েছে, তারা কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য এবং নতুন ডিসি হিসেবে যিনি আসছেন তাঁর সঙ্গেও একই ধরনের সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার জন্য এত সংবর্ধনার আয়োজন করছে বলে আমাদের ধারণা। তা ছাড়া জেলা প্রশাসক মন্ত্রণালয়ে বদলি হলে সেখানেও সম্পর্কের সূত্রে তদবিরের সুবিধালাভের সুপ্ত বাসনাও আছে কারও কারও মনে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ডিসি সাহেব বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য কীভাবে বা কোত্থেকে দেন। সরকারি আচরণবিধির ৮ ও ৯ ধারার ক্ষমতাবলে জেলা প্রশাসকেরা আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। ‘আপৎকালীন’ বলা হলেও এলআর (লোকাল রিলেশনস) ফান্ডের জন্য সারা বছরই অর্থ আদায় করা হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রের কিছু ব্যয় মেটানোর উদ্দেশ্যে এই তহবিল পরিচালনার কথা বলা হলেও ডিসি-ইউএনওরা ব্যক্তিগত স্বার্থে এই অর্থ ব্যবহার করেন কি না, তা বোঝার উপায় থাকে না। কারণ, এই তহবিল অডিটের ব্যবস্থা নেই।

এলআর ফান্ডের অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগেই। এ বছরের মে মাসে এই তহবিলকে আইনি ভিত্তি দিয়ে তা ব্যবহারের নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ নিয়ে একটি সভাও করেছিল। বলা বাহুল্য, মন্ত্রিপরিষদের এ উদ্যোগে খুশি হতে পারেনি জেলা প্রশাসন। উদ্যোগটি কী অবস্থায় আছে, তা আমাদের জানা নেই।

যা-ই হোক, চট্টগ্রামের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনকে প্রচুরসংখ্যক সংবর্ধনা দেওয়ার পেছনে অনেকেই যুক্তি দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি এ বছর শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতি লাভের জন্য কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়, তা জানা নেই। তবে মোটা দাগে চট্টগ্রামে থাকাকালে রুটিন কাজের বাইরে মেজবাহ উদ্দিন সাহেবের কোনো বড় অবদান স্মরণ করতে পারছি না। বরং চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা যখন প্রকৃতিশোভিত ডিসি হিল পার্ককে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার আন্দোলন করছিলেন, তখন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ডিসি পাহাড়ের চূড়ায় জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের যে বাসভবন আছে, তা কিছুতেই স্থানান্তর করা যাবে না—ক্ষমতার দাপটে এই জেদ বজায় রেখে তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। ডিসি হিল উন্নয়নের জন্য জনগণের দাবির মুখে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেই অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনের সামনে একটি ফোয়ারা ও তাঁর নিজের (ডিসি) বাসভবনের পেছনে একটি গোলঘর নির্মাণ করে।

চট্টগ্রামে একসময় মোকাম্মেল হক, ওবায়দুল্লাহ খান (কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ) ও হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো সংস্কৃতিমান জেলা প্রশাসকেরা ছিলেন। তাঁদের বিদায়ের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁদের অবদানের কথা মানুষ এখনো মনে রেখেছে। চাটুকার পরিবেষ্টিত থেকে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে স্থান পেতে হলে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারটি অনুধাবন করতে হয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক  সাংবাদিক