‘মরিবার আগে একটিবার শুকনা মাটিতে হাঁটিবার চাই’

যশোর-খুলনা অঞ্চলের ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৮ বছরে নেওয়া হয় ৫টি প্রকল্প। খরচের পরিমাণ অন্তত ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল মেলেনি ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের। নানা অনিয়ম আর একের পর এক প্রকল্পের ব্যর্থতায় আশাহত এই এলাকার বাসিন্দারা। ভবদহের সমস্যা ও সেখানকার মানুষের ভোগান্তি নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা

ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মশিয়াহাটী ডিগ্রি কলেজের মাঠে পানির মধ্যে দাঁঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটিফাইল ছবি: প্রথম আলো

অভয়নগরের ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে দেখা হয়ে গেল জীবন মণ্ডলের সঙ্গে। জীবনানন্দের গন্ধ থাকলেও শিরোনামের কথাগুলো তাঁর। 

জীবনই আমাকে শনাক্ত করে বললেন, ‘ভাই দেখি তেমনি আছেন। একটু শুকো গেছেন, কিন্তু ফিট; কী বলেন? আমি কেমনে কেমনে বুড়ো হয়ে গেলাম।’

জীবন মণ্ডলের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়–বিধ্বস্ত সাতক্ষীরার তালায়। তাঁর বয়স তখন বড়জোর কুড়ি বা একুশ হবে। তালার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজের ছাত্র। 

কুড়ির সঙ্গে ৩৭ যোগ করলে ৫৭ বছর হয়। কিন্তু জীবনকে দেখে মনে হবে তিনি ৭৫ পেরিয়ে গেছেন। আজ থেকে ৩৭ বছর আগে কয়েক সপ্তাহ আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম সাতক্ষীরায়।

ঘূর্ণিঝড় ত্রাণ কর্মসূচির সেই উদ্যমী জীবন যেন ধূসর হয়ে গেছেন।

২.

সেই ’৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তালার চেয়েও ক্ষতি হয়েছিল সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী এলাকা। ক্যাম্প করে সেখানে থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়।

জীবনানন্দের মহাভক্ত জীবন মণ্ডলের ব্যাগে সেখানেও মজুত থাকত ঝরা পাতা, ধূসর পাণ্ডুলিপি, রূপসী বাংলা, সাতটি তারার তিমির। আলোহীন ক্লান্ত সেদিনের ত্রাণ ক্যাম্পে জীবন ছিলেন একমাত্র বাতি। অন্ধকার রাতে তিনি কবিতা শোনাতেন… 

‘অনেক গভীর রাতে দেখা গেল জোনাকি পোকার সাথে নক্ষত্রের তলে 

শিমগুলো খেলা করে শিশিরের জলে;

আমাকে দাঁড়াঁতে দেখে বলে তারা: “বুঝেছ তো কে এই জোনাকি?”

“চিনেছো?” বললে রাতের লক্ষ্মীপাখি।’

জীবন মণ্ডল ভবদাহ অঞ্চলের মানুষ। পাঠকেরা অনেকেই জানেন ভবদহ অঞ্চল যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। 

এই এলাকার পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদের মাধ্যমে। তবে পলি পড়ে নদীগুলো নাব্যতা হারানোয় পানি নিষ্কাশনে
সমস্যা হচ্ছে।

ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের সবুজ মণ্ডলের বাড়ির উঠানে হাঁটুপানি। দিনের বেলায়ও জীবনের চারদিকে ‘ধূসর অন্ধকার’। হারিয়ে গেছে ‘জীবনের জোনাকি, শিম বনের রাতের লক্ষ্মীপাখিরা’। 

৩.

জীবন মণ্ডলের ৫৭ বছরের জীবনের প্রায় ৪২ বছর কেটে গেছে জলাবদ্ধতায়। নথিপত্র বলছে, ১৯৮১ সালের পর থেকে জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে।

জোয়ারের সঙ্গে ভেসে আসা পলি স্লুইসগেটের মুখে জমা হয়ে নদীর গতিপথ সরু হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নদীর দুই কূল ছাপিয়ে সমতল প্লাবিত হয়।

প্রতিবছরই এমনটা কমবেশি হয়। এ বছর কেশবপুর, মনিরামপুর, অভয়নগর, ডুমুরিয়া অঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের বসতভিটার পানি আর নামছে না।

ভুক্তভোগীদের ধারণা, ভবদহ বিলের এ জলাবদ্ধতা সমাধানের জন্য টিআরএম স্থাপন, আমডাঙ্গা খাল খনন, ২৭ বিল এলাকার অকাল জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত বিল খুকশিয়ার ওয়াপদার স্লুইসগেটের পলি অপসারণ জরুরি। 

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৮ বছরে নেওয়া হয় পাঁচটি প্রকল্প। খরচের পরিমাণ অন্তত ৭০০ কোটি টাকা।

কিন্তু সুফল মেলেনি ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের। নানা অনিয়ম আর একের পর এক প্রকল্পের ব্যর্থতায় আশাহত এই এলাকার বাসিন্দারা।

এসব কথা উঠতেই জীবন থামিয়ে দেন। বলেন, ‘ওসব কথা কয়ে আর কী হবে? আপনিও জানেন, আমিও জানি। যাদের কাছে সমাধান চাই, তারাই সমস্যার মূল কারণ। বড় বড় মানুষদের সঙ্গে আপনার ছবি দেখি। তাগোরে কিছু কবার পারেন না।’

যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধ বিল কেদারিয়া
ছবি: প্রথম আলো

৪.

জীবন মণ্ডলের কথায় মনে পড়ে ১৯৯৭ সালের ৯ সেপ্টেন্বর যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সিইজিআইএস-এর জাতীয় কর্মশালার কথা। মিলনায়তনের বাইরে লাল সালুতে সাদা কাগজ কেটে জলাবদ্ধতার শিকার জনগণের নানা দাবি নিয়ে জীবন মণ্ডলরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ব্যানারের এক পাশে কাস্তে-হাতুরির মনোগ্রামও ছিল।

জনগণের দীর্ঘ আন্দোলন, সিইজিআইএসের স্টাডি রিপোর্ট, দাতা সংস্থার ইতিবাচক মনোভাব এবং তৎকালীন পানিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘বুকে পাথর চাপা’ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা নদী অববাহিকায় ‘জোয়ারাধার’ ধারণাটি মেনে নেয়।

টিআরএম হলো মূল নদীর অববাহিকায় নির্বাচিত বিলে নদীর দিকে কিছু অংশ খোলা রেখে চারদিক দিয়ে পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ করে বিলে জোয়ার–ভাটা চালু করা। সমুদ্র থেকে জোয়ারের সঙ্গে ভেসে আসা পলি ‘কাট পয়েন্ট’ দিয়ে বিলে প্রবেশ করে অবক্ষেপিত হয়ে ভাটায় চটজলদি নেমে যাবে।

সাধারণত ৬০০ হেক্টর জমিতে তিন বছরব্যাপী জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে পলি তুলে বিলকে উঁচু করার পাশাপাশি নদীর নাব্যতা বাড়ানোই ছিল প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

এরপর ১৯৯৮ সালে ১৭ জানুয়ারি বামপন্থী কৃষক সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতারা, ভবদহ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতারা, যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আরেকটি সেমিনার করে। সেমিনারে বিশিষ্ট পানি–বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, পরিবেশবিজ্ঞানী ড. স্বপন আদনান, বিশিষ্ট প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

তাঁরাও জোয়ারাধারের পক্ষে মূল্যবান মতামত প্রদান করেন। ফলে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিল ভায়নায় স্থানীয় জনগণ স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে টিআরএম চালু করে ভালো ফল পায়।

জীবন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার যা হয় হবে। চীনারা ঘুরে গেছে। উপদেষ্টারাও অনেক আশ্বাস দিয়ে গেছেন। সে যখন তেল জুটবে তখন রাধা নাচবে। শহীদ ভাই (প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ) থাকলে তেল আর রাধার হিসাব চাইতেন। তবে কিছু হোক না হোক স্কুলগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা হোক। দুপুরে তাদের খাবারের ব্যবস্থা হোক। লেখাপড়া একেবারে লাটে উঠেছে। এটা ঠেকাতে হবে।’

৫.

সিদ্ধান্ত ছিল, ধাপে ধাপে বিল কেদারিয়া, বিল খুকশিয়া আর বিল কাপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন হবে। বিল কেদারিয়া, বিল খুকশিয়ায় টিআরএম চালু হলেও কাপালিয়ায় কিছুই হয়নি। কেন হয়নি?

কারণ, ‘বুকে পাথর চাপা’ দেওয়া মানুষেরা তত দিনে বুকের পাথর নামিয়ে ফেলেছেন। বছর চারেক আগে এসব নিয়ে প্রথম আলো খবর করেছিল ‘দরকার টিআরএম, পাউবোর পছন্দ নদী খনন’ ( ৭ নভেম্বর ২০২০)। 

এসবের পেপার কাটিং আছে জীবন মণ্ডলের আধভেজা ফাইলে। হাসতে হাসতে বলেন, ‘এগুলি এখন ভেজা আবহাওয়ায় ড্যাম্প হয়ে যাচ্ছে আমাদের মতো। মাঝে মাঝে রোদে দেই। সারা দিন সারা রাত বসে থাকি জলের পরে এই জলচৌকিতে। গরুটা গাভিন, তাকে রেখেছি ঘরে। আমাদের মেইন রাস্তায় যাওয়ার কায়দা নেই। এই জীবন মাইনা নিছি। রিয়ালিটি মাইনা নিছি।’

একটু পরে প্রয়াত শ্রমিকনেতা জসিম মণ্ডল যেন তাঁর ওপর ভর করে। তাঁর ভঙ্গিতে চোখ দুটো বড় বড় করে বলতে থাকেন, ‘আমার জীবন নিয়ে ভাবি না। কিন্তু আমাদের ছেলে–মেয়েরাও মনে করতে শুরু করেছে, এটাই জীবন । ঘরের মধ্যে জল থাকবে ছয় মাস, উঠানে নয় মাস, গরু থাকবে ঘরে, আমরা বারান্দায়। স্কুলে যেতে হবে গামছা পরে, বই থাকবে পলিথিনে। কোনো দিন ক্লাস হবে, কোনো দিন হবে না। শুকনা গ্রামে শিশু গৃহশ্রমিকের ছদ্মবেশে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে বয়সের আগে। ছেলেরা যাবে ইটভাটায়। এই কি জীবন?’

 ক্লান্ত ধূসর জীবন মণ্ডলের এখন একটাই আরজি, ‘মরিবার আগে একটিবার শুকনা মাটিতে হাঁটিবার চাই।’

‘যশোরের দুঃখ’ ভবদহ। চারদিকে থই থই পানির কারণে মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন ছোট নৌকা।
ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

৬.

জীবন মণ্ডল বুঝতে পারেন ঢাকায় ফিরে আমাকে জলাবদ্ধতায় আশুকরণীয় আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে জাবর কাটতে হবে। অক্ষর গুনে লিখতে হবে। তাঁর জীবনের ঝরাপাতা অথবা পালকের কোনো দাম নেই।

জীবন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার যা হয় হবে। চীনারা ঘুরে গেছে। উপদেষ্টারাও অনেক আশ্বাস দিয়ে গেছেন। সে যখন তেল জুটবে তখন রাধা নাচবে। শহীদ ভাই (প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ) থাকলে তেল আর রাধার হিসাব চাইতেন। তবে কিছু হোক না হোক স্কুলগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা হোক। দুপুরে তাদের খাবারের ব্যবস্থা হোক। লেখাপড়া একেবারে লাটে উঠেছে। এটা ঠেকাতে হবে।’

জলাবদ্ধতার চূড়ান্ত সমাধান নিয়ে তাঁর আর কোনো আশা নেই। তারপরও বললেন, জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে টিআরএম ছাড়া গতি নেই। বিল কাপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না। আমডাঙ্গা খাল সংস্কার করলে জলাবদ্ধতা কমবে। 

এ ছাড়া টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে হরি নদের অবাধ সংযোগ স্থায়ী করতে হবে। পোল্ডারের ভেতরে আটকে থাকা নদীগুলোকে মুক্ত করে ভৈরব, কপোতাক্ষ ও বিল ডাকাতিয়ার সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে হবে। 

দিন দুয়েক পরে এক টিভি টক শোতে অধ্যাপক আইনুন নিশাত একই কথা বললেন, টিআরএম ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর হবে না। 

একসময় ওই এলাকায় যে অষ্টমাসি বাঁধের মাধ্যমে পলি ও পানি ব্যবস্থাপনা করা হতো, তার বৈজ্ঞানিক ও পরিকল্পিত রূপ হচ্ছে এই টিআরএম। এটি না করে শুধু নদী খননের কাজ করলে খনন কোম্পানি ও ঠিকাদারদের লাভ হবে, কিন্তু এই জনপদের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে না।

গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক। [email protected] 

*মতামত লেখকের নিজস্ব