রমজান মাস: যেভাবে সম্ভব হলো মক্কা বিজয়

ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিজয় ও মানবতার চূড়ান্ত বিজয় সংঘটিত হয় অষ্টম হিজরি সনের ১৯ রমজান। ইসলাম মানবতার জন্য, সত্য সুন্দর ন্যায় ও কল্যাণের জন্য ইসলাম; ইসলাম শান্তি সম্প্রীতি মৈত্রী সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎ কাজে আদেশ দেবে, মন্দ কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখবে।’ (সুরা আলে ইমরান)।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে চরমভাবে পরাজিত হলেও পরের বছর শাওয়াল মাসে তারা প্রায় পাঁচ শ কিলোমিটার দূরে এসে পুনরায় মদিনা আক্রমণ করে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ। ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) উমরার উদ্দেশ্যে দেড় হাজার সাহাবিসহ মক্কা গমন করেন। কুরাইশরা বাধা দিলে হজরত (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। সেখানেই সম্পাদিত হয় ঐতিহাসিক ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’, যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি।

‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র পর মক্কার ‘বনু খোজাআ’ গোত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে এবং ‘বনু বকর’ গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। কুরাইশদের প্ররোচনায় ‘বনু বকর’ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ‘বনু খোজাআ’ গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’-এর নিভৃত এলাকায় হামলা করে, অসহায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন করে। প্রাণ ভয়ে কাবায় আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খোজাআ সম্প্রদায় মদিনার মিত্র মুসলমানদের সহযোগিতা চায়।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই অপকর্মের প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের জানালেন, তোমরা বনি খোজাআ গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও, নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো; না হলে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে হেতু এ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করল।

বিশ্ব মানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকাররমাকে পঙ্কিলতামুক্ত করার জন্য অষ্টম হিজরিতে বিশ্বনবী নীরব আয়োজন করলেন। তিনি ধ্বংস চান না, তিনি কুরাইশদের রক্ষা করতে চান। তিনি চান প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বকে জয় করতে। মুহাম্মদ (সা.) ১০ রমজান ১০ হাজার সাহাবিসহ মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে অভিযাত্রা শুরু করেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মাওয়ারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করলেন। ১৯ রমজান রাতে আবু সুফিয়ান, হাকিম ইবনে নিজাম ও বুদাইলকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলে হজরত উমর (রা.)-এর নেতৃত্বে টহলরত ছদ্মবেশী গেরিলা সাহাবিদের হাতে বন্দী হয়ে তাঁরা নবীজি (সা.)-এর কাছে নীত হন। দীর্ঘ ২১ বছরের নিষ্ঠুরতার নাটের গুরু আবু সুফিয়ানকে রহমতের নবী (সা.) প্রেম-ভালোবাসার দীক্ষা দিলেন, পাষাণ হৃদয় দয়ার সাগরে স্নাত হলো; তিনি ইমান আনলেন।

প্রিয় নবী (সা.) মক্কা জয়ের আগেই মক্কাবাসীর মন জয় করা বড় বিজয় অর্জন মনে করলেন। এ সময় নবীজির চাচা হজরত আব্বাস (রা.) যিনি কৌশলগত কারণে মক্কাবাসীর কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখেছিলেন, তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ করলেন। প্রভাতে এ উভয় কুরাইশ নেতাকে নবীজি (সা.) শান্তির পয়গাম ঘোষণার জন্য মক্কায় পাঠালেন এবং ঘোষণা দিতে বললেন, ‘যারা কাবা গৃহে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে বা তার নাম বলবে, তারা নিরাপদ, যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

১৯ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’ ইতিপূর্বে ‘মুতা’ অভিযানেও তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘কোনো সাধু-সন্ন্যাসীকে হত্যা করবে না, বালক-বালিকা ও শিশুদের হত্যা করবে না, নারীদের হত্যা করবে না, বৃক্ষনিধন করবে না, শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করবে না, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করবে না এবং আত্মসমর্পণকারীকে আঘাত করবে না।’ এভাবে জানের দুশমনদের প্রাণের দোসর বানিয়ে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি। যেখানে উদারতার আকাশে ক্ষমার শুকতারা দীপ্তি ছড়াচ্ছে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত উসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে, অবনত মাথায় সবার শেষে মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করলেন। হজরত (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। সভায় ভাষণে তিনি সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন, ‘হে কুরাইশগণ! অতীতের সব ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সবাই এক হও। সব মানুষ সমান, এ কথা বিশ্বাস করো।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সবাইকে এক নারী ও পুরুষ হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের গোত্রে ও সম্প্রদায়ে পৃথক করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত, যে বেশি পরহেজগার।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
    যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
    সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
    [email protected]