অনিয়মের নির্বাচন ফিরুক নিয়মের ছন্দে

ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ দফা নির্বাচনে সহিংসতায় ১০০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তা ছাড়া অনিয়মে জর্জরিত ছিল এসব নির্বাচন। এখন অনিয়মই যেন বাংলাদেশের নির্বাচনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নামে কথিত নির্বাচন চলতি মহামারির মতোই রূপ পাল্টাচ্ছে। আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই; যখন খোদ নির্বাচন কমিশন বলছে যে নির্বাচনে হানাহানি আর মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী নয়। অবশ্য এমন বক্তব্য অতীতে আর কোনো নির্বাচন কমিশন থেকে শোনা যায়নি। কারণ, নির্বাচন পরিচালনা মানেই হচ্ছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের তারিখের পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নির্বাচনসংক্রান্ত সব কার্যক্রম ও শান্তিশৃঙ্খলার পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। শুধু তা–ই নয়, পরবর্তী ১৫ দিন নির্বাচনের কার্যক্রমের জন্য নিয়োজিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের আওতাতেই থাকেন। অনুরূপভাবে থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও। অতীতে এই সময়সীমা বাড়ানোর দাবিও উঠেছিল।

নির্বাচনকালীন প্রতিটি কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা পরিপত্র দিয়ে ঘোষিত হয়। নির্বাচন কমিশনের এসব পরিপত্র আইনি ক্ষমতাবলে জারি করা হয়। তবে নির্বাচনকালীন সিকিউরিটি ও ডিপ্লয়মেন্ট ম্যানুয়েল না থাকা বা প্রস্তুত না করার কারণে প্রতি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়োগ, সংখ্যা, স্তর ও বিভিন্ন অবস্থায় করণীয় সম্বন্ধে উল্লেখ থাকলেও বিশদভাবে থাকে না। অপরদিকে স্থায়ী কোনো ম্যানুয়াল না হওয়ার কারণে প্রতি নির্বাচনের সময় নতুন পরিপত্র জারি করতে হয়, যার মান এক রকমও হয় না। এর স্থায়ী সমাধানকল্পে আমি বহুদিন থেকে ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড কমপ্লেইন্ট’ ম্যানুয়াল তৈরির ওপর জোর দিয়ে আসছি।

যাহোক, প্রশ্ন ছিল যে এবারের ইউপি নির্বাচনে পাঁচ ধাপে হানাহানিতে মৃত্যুর দায়িত্ব কার। এর চূড়ান্ত দায়িত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের এবং মাঠের দায়িত্ব যাঁদের হাতে ছিল, অবশ্যই তাঁদের জবাবদিহি করানোর দায়িত্বও কমিশনের। এ দায়িত্ব এড়ানোর উপায় নেই। কমিশনের মতে, এর দায়দায়িত্ব প্রার্থীর এবং সমর্থকদের। নির্বাচনের সময় তাঁরাও কমিশনের আইনের পরিধিতে ন্যস্ত। তাই প্রশ্ন থাকে যে কমিশন যদি দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করেই থাকে, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অথবা আদৌ নেওয়া হয়েছে কি না অথবা কয়টা হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেসব কতটুকু জানা গেছে। এখানে চূড়ান্ত দায়িত্ব নিরূপণ করা ব্যতিরেকে মনে হয় সবাই বিষয়টা বেমালুম হজম করে নিয়েছি। তবে কার দায়িত্ব, এটা অবশ্যই নিরূপণ করা দরকার, যা একমাত্র উচ্চ আদালত করতে পারেন। কারণ, এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আরও অনেক নির্বাচন হবে আর প্রতিবারই হয়তো আমরা এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হব এবং হয়তো একই ধরনের উত্তর পাব আর অনিয়মকে নিয়ম মনে করে নেতিবাচক নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশ করে নেব।

২.

আজ ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের অন্যতম ও বিভিন্ন কারণে বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনকে মেয়র নির্বাচন বলা হলেও আসলে করপোরেশনের পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যার পুরোধায় থাকেন মেয়র। কারণ, আমাদের স্থানীয় সরকারের কাঠামো কেন্দ্রীয় সরকারের আদলে নয়। এখানেই সমস্যা ও বিভ্রান্তি। এক দেশে দুই ধরনের শাসনকাঠামো। এ কারণেই এসব নির্বাচন ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা মেয়র বা চেয়ারম্যানকেন্দ্রিক হয়ে রয়েছে। এর পরিবর্তনের কথা অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে যখন এসব নির্বাচন সীমিত আকারে দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্মরণযোগ্য যে মেয়র ছাড়া কাউন্সিলররা নির্দলীয় নির্বাচিত হচ্ছেন। এখানেই যত সমস্যা। থাক, সে প্রসঙ্গে না-ই গেলাম। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ের ওপরই কিছু আলোকপাত করছি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর এর মধ্যে দুটি নির্বাচন হয়েছে এবং তৃতীয় নির্বাচন আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের প্রথম নির্বাচনটি হয় ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর। ওই নির্বাচন তখনো দলীয় আবরণ পায়নি কিন্তু প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের (প্রায় করপোরেশনজুড়ে আসন) সাংসদ শামীম ওসমান। তাঁদের হেভিওয়েট প্রার্থী মনে করা হয়। এবার অবশ্য টানা দুবারের মেয়র আইভীর প্রতিপক্ষ নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ রাজনীতিবিদ তৈমুর আলম খন্দকার। যিনি বিএনপির নেতা হলেও দলের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। এরই মধ্যে বাদানুবাদ এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেও প্রায় শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারণা আমরা দেখেছি।

নারায়ণগঞ্জে গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল এবং একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের নির্বাচনে তেমনটা দেখা যায় না। তবে এবার যেহেতু অন্য বড় দল অংশগ্রহণ করছে না, সে কারণে দলীয় প্রতিযোগিতা যেমন হবে না, তেমনি উত্তেজনাও দেখা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জের গুরুত্ব বিবেচনায় এবং কিছুটা স্থানীয় জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে এবারের নির্বাচন নিয়েও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন খবর প্রকাশিত হয়। এর এক প্রান্তে রয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিতে আইভীর কথিত প্রতিপক্ষ শামীম ওসমান, যদিও দুজনই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তাঁদের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আভাস পাওয়া যায়। যদিও আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যে ঠান্ডা, মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত লড়াইয়ের বিষয়ে চাউর হওয়ার পর শামীম ওসমান প্রকাশ্যে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নৌকার পক্ষে কাজ করার এবং সমর্থনের বক্তব্য দেন। এরপরও গুঞ্জনের সমাপ্তি ঘটেনি।

এ গুঞ্জন, গুঞ্জন খণ্ডন ইত্যাদির মধ্যে বেশ কিছু পত্রপত্রিকার খবর পরিবেশন থেকে জানা যায়, ২৭টি কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ৯টি নারী কাউন্সিলর আসনে সাংসদ তাঁর সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁদের জিতিয়ে আনার চেষ্টা তো অবশ্যই চালাবেন। উল্লেখ্য, কাউন্সিলর পদে কোনো দলীয় প্রতীক দেওয়া হয় না। কাজেই এক দল থেকেই একাধিক ব্যক্তির প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই। এ ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা বলে এই দুজনের (আইভী ও শামীম ওসমান) সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের আগে না হলেও নির্বাচনের দিন উত্তেজনা বিরাজ করতে পারে। বিশেষ করে কদমরসুল, মিজমিজি ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়।

ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, শামীম ওসমান সাংসদ হিসেবে তাঁর উন্মুক্ত সংবাদ সম্মেলন এবং প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দেওয়া এমনকি প্রচারণায় অংশ নেওয়া আচরণবিধিসিদ্ধ কি না। উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই। ২০১০ সালে প্রণীত বিধিমালায় সাংসদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া বারিত করা হয়েছিল। কারণ, ওই সময় এ স্তরের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা দল দ্বারা প্রার্থী দেওয়া হতো না। নির্বাচনগুলো ছিল নির্দলীয়। যে কারণেই সরকারের সুবিধাভোগী, যার মধ্যে সাংসদেরাও অন্তর্ভুক্ত এরূপভাবে প্রচারণা বা উন্মুক্ত সমর্থন ঘোষণা করতে পারতেন না। কিন্তু সে অবস্থা এখন নেই। কারণ, বর্তমানে এই স্তরের নির্বাচনও দলীয় পরিচয়ে বা প্রতীকে হচ্ছে। যদিও মেয়র অথবা চেয়ারম্যান পদে, কাজেই ২০১০ সালের বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি কমিশনের ভেবে দেখতে হবে এবং প্রয়োজনে বিধিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। তবে শামীম ওসমানের ক্ষেত্রে বিধিটি বিদ্যমান ও কার্যকর, কাজেই এ বিধি অবশ্যই লঙ্ঘিত হয়েছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না, সে বিষয়ে ১২ জানুয়ারি ২০২২-এ প্রধান নির্বাচন কমিশনের মন্তব্য আমরা দেখতে পাই। আপাতত এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। তবে আমি মনে করি, এখন এই বিধির পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়েছে।

৩.

নারায়ণগঞ্জে গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল এবং একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের নির্বাচনে তেমনটা দেখা যায় না। তবে এবার যেহেতু অন্য বড় দল অংশগ্রহণ করছে না, সে কারণে দলীয় প্রতিযোগিতা যেমন হবে না, তেমনি উত্তেজনাও দেখা যায়নি। এরপরও দৃশ্যমান যে বেশ রমরমা প্রচারণা চলেছে। আশা করা যায়, এবারও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। অন্তত এখানে অনিয়মই নিয়ম হবে না।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

    [email protected]