ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের আকুতি অন্য কোথাও দেখা যায় না কেন?

রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের অনেক নাগরিক পোলান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে এক আশ্রয়শিবিরে এক নারী ও শিশু
ছবি: রয়টার্স

‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে।/ কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’

বাঙালি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের এই কবিতা আমরা সেই ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি। আর এই কবিতার মর্মার্থ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউরোপের সরকারগুলো অনুধাবন করছে। যুদ্ধ মানেই বিধ্বস্ত জনপদ, হত্যালীলা আর অশ্রুপাত। যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার অর্থ মানুষের গভীর মানবিক দিকটাকে অবহেলা করা।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার এই হামলা গণতন্ত্র ও মুক্ত পৃথিবীর প্রতি হামলা।’ আর পশ্চিমা মিত্ররাও জেলেনস্কির কথাকেই জ্ঞান করছেন; যেন গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অবশ্যই নিন্দনীয়। তবে পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সমাজের এই সংহতি সচরাচর দেখা যায় না। আজ খোদ ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধের এই দংশন হচ্ছে বলেই কি এ সংহতি!

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আর নানা মানবিক সহযোগিতা, অর্থ ও মারণাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমা শক্তি। প্রায় ৮০ বছর পর ইউরোপীয় দেশগুলোর ‘যুদ্ধ নয় শান্তি ও সংহতি’র হিসাব আচমকাই পাল্টে গেছে। ইউরোপের ভৌগোলিক অবস্থানে উত্তর-পূর্ব দিকে বিশাল অংশজুড়ে রাশিয়ার সীমান্ত। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে পশ্চিম ইউরোপের দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ জোট—সবাই এককাট্টা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিজ মহাদেশে সাবেক যুগোস্লাভিয়া বা বলকান যুদ্ধের পর এমন বড় যুদ্ধ ইউরোপের জনগণ দেখেনি। এখন প্রতিদিন কাগজের পাতা আর টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে আসছে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ, হতাহত হওয়ার খবর এবং লাখো শরণার্থীর প্রাণ বাঁচানোর আকুতি। যেমনটি আমরা দেখি বিশ্বের নানা অঞ্চলের যুদ্ধগুলোয়। তবে সেসব যুদ্ধে পশ্চিমাদের আকুতি বা সংহতি তেমনটি চোখে পড়ে না।
বলা হচ্ছে, ইউরোপে ন্যাটো সামরিক জোটের সম্প্রসারণ বা ইউক্রেনের এই জোটের সদস্য হওয়ার অভিপ্রায় এ যুদ্ধের একটি বড় কারণ। ন্যাটো সামরিক জোট কেন এখনো প্রয়োজন বা কেন এই জোটকে সম্প্রসারণ করার প্রয়োজন পড়ছে, সেটা জানতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার মিত্রশক্তি—সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ফ্যাসিস্ট হিটলারের জার্মানির পৈশাচিক যুদ্ধকে রুখতে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৫ সালের ৮ মে হিটলার বাহিনীকে পরাজিত করে সোভিয়েত লাল ফৌজ বার্লিন দখল করে নেয়। এর পরপরই ছয় বছরব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সময় প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লাল ফৌজের রণকৌশল ও বীরত্ব সর্বজনবিদিত। কিন্তু ১৯৩৯ সালে অ্যাডলফ হিটলার আর স্তালিনের মধ্য পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনৈতিক চুক্তির বিষয় এবং উভয় দেশের মধ্য অনাক্রমণ চুক্তিটি ঐতিহাসিক সত্য। আবার বার্লিন বিজয়ের তিন বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বার্লিনকে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বিভক্তকরণ এবং বার্লিনের পশ্চিম অংশকে ১৯৪৮ সালের জুন মাস থেকে প্রায় এক বছর অবরোধ করে খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া জোসেফ স্তালিনের নির্দেশেই হয়েছিল।
সেই সময় যুক্তরাজ্য ও মার্কিন বিমান অবরুদ্ধ পশ্চিম বার্লিনবাসীকে বিমানে করে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিয়েছিল। জোসেফ স্তালিনের এসব অবিশ্বাসী আচরণের কারণে মূলত ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ৯ দেশ মিলে ন্যাটো সামরিক জোট তৈরি করে। যদিও সেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বহু আগেই লুপ্ত হয়েছে, তবে বর্তমানে ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসী ভূমিকাকে স্তালিনের রাজনীতির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে বা স্বচ্ছ গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশেই এমন শাসন রয়েছে। আট বছর ধরে সৌদি আরব প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে যুদ্ধ চালিয়ে আড়াই লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। পশ্চিমারা এ কথা জানার পরও সৌদি আরবের প্রতি কোনো অবরোধ তো দূরে থাক, দেশটির কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো অস্ত্র বিক্রি করছে দেদার। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মানবিকতা ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অস্ত্র ব্যবসার কাছে মাথা নত করেছে।

অন্যদিকে, বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক ইউরোপীয় দেশ অস্ত্র বিক্রির জমজমাট ব্যবসা করলেও নিজেদের সেনাবাহিনীকে তেমনটি করে গড়ে তোলেননি, যা দিয়ে রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে ঠেকানো যায়। তবে ন্যাটো জোটের অনেক সদস্যদেশ বিগত সময়ে মার্কিনদের সব যুদ্ধের সঙ্গী হয়নি। তবে খোদ ইউরোপে যুদ্ধ নিয়ে এখন সবাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক হয়েছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার বিষয়ে জার্মানি ও ফ্রান্স আপত্তি করলেও মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে বেশি উৎসাহিত ছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করার আগে পশ্চিমা নেতারা ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে অনেক কূটনৈতিক কথাবার্তা বললেও প্রেসিডেন্ট পুতিন তা আস্থায় নেননি। এ মুহূর্তে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্য এমন কেউ নেই, যিনি মার্কিনদের বলতে পারেন, ন্যাটো জোটের বিস্তৃতির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বিষয়টি ইউরোপীয় রাজনীতিকদের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা

পশ্চিমা জোট যে কথা বলে রাশিয়ার বিরুদ্ধ নানা আর্থিক অবরোধ বা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তা হলো সার্বভৌম ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার এই হামলা গণতন্ত্র ও মুক্ত পৃথিবীর প্রতি হামলার শামিল। রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে বা স্বচ্ছ গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশেই এমন শাসন রয়েছে। আট বছর ধরে সৌদি আরব প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে যুদ্ধ চালিয়ে আড়াই লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। পশ্চিমারা এ কথা জানার পরও সৌদি আরবের প্রতি কোনো অবরোধ তো দূরে থাক, দেশটির কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো অস্ত্র বিক্রি করছে দেদার। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মানবিকতা ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অস্ত্র ব্যবসার কাছে মাথা নত করেছে।

পশ্চিমারা যদিও বলছে, এ যুদ্ধ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই; তবে এই যুক্তি ধোপে টিকছে না। চিলিতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়রগে হাইনে জার্মানির সুদ ডয়চে যাইটুং পত্রিকায় গত শনিবার একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা এক হয়েছে, তা সঠিক; তবে আমরা যদি আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দিকে তাকাই, তবে তাদের বেশির ভাগ দেশ এই যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা অবরোধের বিষয়ে একমত নয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা করা উচিত। তবে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের অনেক অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট খারাপ। আর পশ্চিমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নানা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইউক্রেনের যুদ্ধের চেয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ক্ষুধার্ত হয়ে মারা যাবে আরও বেশি মানুষ।’

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি। [email protected]