অবশেষে চূড়ান্ত বিজয়: ঢাকা ও চট্টগ্রাম

মুক্তিযুদ্ধের বই: এবার বিজয় দিবস সামনে রেখে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজনের বিষয় দেশি-বিদেশি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হলো এসব বইয়ের নির্বাচিত অংশ থেকে। আজকের নির্বাচিত বই তাদামাসা হুকিউরার লেখা রক্ত ও কাদা ১৯৭১। জাপানি এই ভদ্রলোক ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী আট মাস আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ বইটি সেসবের স্মৃতিচারণা। নিচের নির্বাচিত অংশে বিজয়ের মুহূর্তে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁর দেখা কিছু ঘটনার চিত্র পাওয়া যায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

.
.

ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব আর্মি স্টাফ ফিল্ড মার্শাল মানেকশ পাকিস্তানের প্রতি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আত্মসমর্পণের যে সুপারিশ করেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সর্বোচ্চ কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি শেষ পর্যন্ত সেটি মেনে নিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায়, অর্থাৎ বেঁধে দেওয়া সময়সীমার ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি তাঁর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন।
বেলা একটায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার পক্ষে চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব আত্মসমর্পণের শর্তাবলিসংবলিত চুক্তির খসড়া বহন করে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তির বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বেলা তিনটার পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি খসড়া অনুমোদন করে তাতে স্বাক্ষর করেন। তিনটা ২০ মিনিটে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা তিন বাহিনীর প্রধান, সেই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের সঙ্গে আগরতলা থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি তাঁকে স্বাগত জানান।
বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে স্থাপিত অনাড়ম্বর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানস্থলে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয় এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। শেষ পর্যন্ত ঢাকা রণাঙ্গনে পরিণত হয়নি। রেডক্রসের ঢাকা অফিসে কর্মরত বাঙালি সহকর্মীরা স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্য রেসকোর্স ময়দানে ছুটে যান। ভারতীয় সেনারা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিদের রক্ষা করছে দেখে তাঁরা অবাকই হয়েছিলেন বটে, কিন্তু এ কথা বুঝতে দেরি হয়নি যে সেখানে সমবেত ৫০০ জনের মতো ক্ষুব্ধ মানুষের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধানদের রক্ষা না করলে নির্বিঘ্নে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা আদৌ সম্ভব ছিল না। লোকজন পাঞ্জাবিদের প্রতি ‘শয়তান’, ‘খুনি’ বা ‘নরকে যাও’—এসব গালিগালাজ দিতে থাকে। আমাদের একজন সহকর্মী নজরুল হক প্রত্যক্ষ করলেন যে এক বাঙালি জুতা দিয়ে মি. নিয়াজির মাথায় মারতে উদ্যত হয়েছেন। নজরুল হক আমাকে বলেন যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি দাঁত চেপে ধরে অত্যন্ত অপমানকর এ ঘটনা সহ্য করার চেষ্টা করছিলেন দেখে তাঁর প্রতি কিছুটা মায়া হয়েছিল।
আরেকজন সহকর্মী মুজাফফর আহমেদের কথায়: চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে গিয়ে মি. নিয়াজির কাছে কলম ছিল না বলে তিনি একটু বিচলিত হন। তা দেখে জেনারেল অরোরা তাঁর নিজের কলম এগিয়ে দেন। চুক্তিতে সই করার পর জেনারেল নিয়াজি জেনারেল অরোরার কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতাকা ও একটি রিভলবার হস্তান্তর করেন। জেনারেল অরোরা রিভলবারটি তুলে তার ম্যাগাজিন খুলে দিলেন। ভেতরে কোনো বুলেট নেই, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। দেখে মি. নিয়াজি ঘাড় কাত করে জানালেন যে কোনো সমস্যা নেই। এভাবে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষ হলো। এ দুজন জেনারেল অতীতে নয়াদিল্লির সামরিক একাডেমিতে সহপাঠী ছিলেন।
বার্তা সংস্থা এপির খবর অনুযায়ী স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ভারতীয় পক্ষকে যে পিস্তল দেওয়া হয়, ১৪ ডিসেম্বর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সাংবাদিকদের সেই রিভলবার দেখিয়েছিলেন। তিনি হাতে পিস্তলটি তুলে বলেছিলেন, এমনকি তাঁর সব সেনা নিহত হয়ে তিনি একলা রয়ে গেলেও এ পিস্তল দিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করবেন। শুধু তিনিই নন, সব পাকিস্তানি সেনা শেষ পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। মি. নিয়াজির এমন মন্তব্য সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঢাকায় যুদ্ধ এড়ানো গেছে। তাতে মনে হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কিছু গোপন সমঝোতা হয়েছে।
এপির খবরে আরও বলা হয়, স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর আনন্দিত জনগণ জেনারেল অরোরাকে কাঁধে তুলে রাস্তায় বের হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে। জেনারেলের ওপরে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি লজ্জায় বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন দেখে লোকজন মজা পেয়েছে...

চট্টগ্রামে শেষ লড়াই
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
চট্টগ্রামে অদ্ভুত রকমের নীরবতা বিরাজ করছিল। মেজর থাপারের বাহিনী চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে। পরিস্থিতি জানতে তাদের সঙ্গে আমিও এই বন্দরনগরে যাই। শহরটিতে কোনো উত্তেজনা নেই। সব চুপচাপ, যেন একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় সব দোকানের দরজা বন্ধ। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাও চোখে পড়েনি। কোনো কোনো দোকানে এখনো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ছবি টাঙানো আছে।
ঢাকার পতনের পরও চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ থামেনি। আগের রাতে বরং তা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তবে আজ সকালে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে দূত এসে জানায় যে চট্টগ্রামে মোতায়েন পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কেবল ভারতীয় বাহিনী নয়, এই আত্মসমর্পণ ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ হিসেবে গণ্য করা হবে, এই শর্তে ভারতীয় পক্ষ সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর চট্টগ্রামে প্রথমে প্রবেশ করে মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী। তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পৌঁছায়। এরপর ভারতীয় বাহিনীর আগমন হলো। শহরের কেন্দ্রভাগে গিয়ে নাগরিকদের আনন্দে মেতে উঠতে দেখলাম। তারা আমাদের ফুলের মালা ও মিষ্টি দিল। কেউ কেউ মেজর থাপার, এমনকি আমাকে ও জাঁ পিয়েরকে পর্যন্ত কাঁধে তুলে নাচতে লাগল।
ভারতীয় সেনাদের বিদায় জানিয়ে আমরা আগ্রাবাদ হোটেলে যাই। আমাদের দুজন সহকর্মী পশ্চিম জার্মানির কোখ ও অস্ট্রিয়ার ইয়ানৎস হোটেলে থাকে। হোটেল ঘিরে রেখেছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রায় এক হাজার সদস্য। তাঁদের কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে এখন হোটেলের ভেতরে রেডক্রসের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়ে আলোচনা করছেন বলে জবাব এল। হোটেলের ভেতরে এক হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা আশ্রয় নিয়েছে বলে জানানো হয়।
সদর দরজার পাশে স্তূপীকৃত বালুর বস্তা। তা পেরিয়ে লবিতে পৌঁছালাম। সেখানে খাটো একজন বাঙালি দীর্ঘকায় কোখের সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলছিল। মুক্তিবাহিনী চায়, হোটেলে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রমুক্ত করার পর দুপুরে তাদের গণ-আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। কোখ মুখ লাল করে দাবি করছেন, মুক্তিবাহিনী যেন জেনেভা চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা চিঠি লেখে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দীদের

ন্যস্ত করা হলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, সেই দুশ্চিন্তা থেকে কোখ বন্দীদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাখতে চাইছেন। নানা অজুহাত দেখিয়ে ভারতীয় সেনারা এখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি কালক্ষেপণের চেষ্টা করছিলেন। সে সময় ইয়ানৎস এল লবিতে। আমি তার কানে ফিসফিস করে বললাম, জার্মান ভাষায় কোখকে জানাও, জাঁ পিয়ের ভারতীয় বাহিনীকে ডাকতে গেছে। আরও আধা ঘণ্টা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হবে।
এরপর আমিও কোখদের আলোচনায় যোগ দিলাম। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। তিনি জেনেভা চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। রেডক্রসের প্রতিনিধির দাবি শুনে তিনি বিরক্ত ও বিচলিত বোধ করছেন। পাকিস্তানি পক্ষ নাকি বলছে, মুক্তিবাহিনী যদি তাদের অস্ত্রমুক্ত করতে চায়, তবে তারা হোটেলের বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত।
পরবর্তী ৩০ মিনিট খুব লম্বা সময় বলে মনে হলো। শেষ পর্যন্ত জাঁ পিয়েরের সঙ্গে মেজর থাপারকে দেখে মনে মনে উৎফুল্ল হলাম। ভারতীয় বাহিনীর ৩০টি ট্রাক এসে পৌঁছাল হোটেলের সামনে। এখানে আসার পথে জাঁ পিয়ের ও থাপার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তৈরি করে এনেছেন। প্রস্তাবটি হলো এ রকম: পাকিস্তানি বাহিনী আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কর্মীদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। মুক্তিবাহিনী তাদের অস্ত্রমুক্ত করার পর ভারতীয় বাহিনী তাদের বন্দিশিবিরে আটক এবং তাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেবে। এ প্রস্তাবে সবাই সম্মত হলো।
রাজাকার ও পাঞ্জাবি সেনা মিলিয়ে মোট ৭৫১ জনকে বন্দী করা হয়। একটি হোটেলে এত লোক কীভাবে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল, ভেবে অবাক হলাম।
চট্টগ্রামের লড়াই এভাবে শেষ হয়েছে। সারা দেশ মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ। আশা করলাম, দেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব যুবক বন্দুক হাতে যুদ্ধে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল, তারা যেন সদ্যপ্রাপ্ত বিজয়ে দীর্ঘদিন মেতে না থেকে দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন সংগ্রামে শরিক হয়।
চি-তো দোরো-তো নামে জাপানি ভাষায় লেখা বইয়ের বঙ্গানুবাদ রক্ত ও কাদা ১৯৭১, লেখক: তাদামাসা হুকিউরা, জাপানি থেকে বঙ্গানুবাদ: কাজুহিরো ওয়াতানাবে, প্রকাশকাল ২০১২, প্রকাশক প্রথমা।