অবস্থা ও ব্যবস্থা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

বাংলাদেশের যাঁরা ভাগ্যবিধাতা বা নীতিনির্ধারক, তাঁরা বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে শতগুণ দড়ো। আমরা যা বুঝি, তাঁরা বোঝেন তার চেয়ে বিশ গুণ বেশি। বিশ্বের যাঁরা ভাগ্যবিধাতা, সেই মহাজ্ঞানী মহাজনদের সঙ্গেও তাঁদের অব্যাহত আলাপ-আলোচনা, সলাপরামর্শ হয়ে থাকে। দেশীয় ও বহির্দেশীয় বুদ্ধির মিশ্রণে ফর্মুলা তৈরি হয়, আগামী দশ বা পনেরো বছরে কী প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশ কী পরিমাণ অগ্রগতি অর্জন করবে।
আজ থেকে ১১০ বছর আগে বাংলাদেশে প্রবল বিবাদ বেধেছিল তিন পক্ষে: ব্রিটিশ সরকার, হিন্দু নেতা এবং পূর্ব বাংলার মুসলমান নেতাদের মধ্যে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক লম্বা প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যার শিরোনাম ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’। তার শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লইতে হইবে না। উপদেশেরও যে বিশেষ প্রয়োজন আছে তাহা আমি মনে করি না।’
পশ্চিমাদের মাথা এখন যেমন বড়, সেকালেও বড় ছিল, বরং কিঞ্চিৎ বেশিই বড় ছিল, কারণ দুনিয়ার বারো আনা ছিল তাদের পদানত। তারা আমাদের কল্যাণের জন্য যে বুদ্ধি ও পরিকল্পনা দেয়, তার ওপরে কোনো কথা নেই। রবীন্দ্রনাথও তা ভালো বুঝতেন, তাই লিখেছিলেন, ‘য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতার অভিমান ইতরকে যে কেবল ঘৃণা করে তাহা নহে, তাহাকে নষ্ট করিবার বেলা ঈশ্বরকে নিজের দলভুক্ত করিতে কুণ্ঠিত হয় না। য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতা নিজেকে জাহির করা এবং বজায় রাখাকেই চরম কর্তব্য বলিয়া জানে। অন্যকে রক্ষা করা যদি তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খাইয়া যায়, তবেই অন্যের পক্ষে বাঁচোয়া, যে অংশে লেশমাত্র খাপ না খাইবে সে অংশে দয়ামায়া বাছবিচার নাই।’
পশ্চিমা দাতাদের প্রণীত ব্যবস্থাপত্রে এবং তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায়, যার নাম সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি), তাতে আমরা প্রচুর সাফল্য অর্জন করেছি—এমন সার্টিফিকেট পাওয়ায় আমাদের আনন্দের শেষ নেই। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবছি, ওই এমডিজি নামক জিনিসটি যদি রচিত না হতো তাহলে আমাদের জনগণ ও সরকার কিছুই করত না। দারিদ্র্য দূর হতো না, ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ দাঁতে দড়ি দিয়ে পড়ে থাকত, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কিছুই অর্জিত হতো না, নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নই উঠত না, মাতৃস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হতো। আমরা ভাতে মরতাম।
সব জাতিকেই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হয় এবং উন্নয়নও একটি অব্যাহত ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, তা যত ধীরগতিতেই হোক। ষোলো শতকে শের শাহের সময় জাতিসংঘও ছিল না, এমডিজিও ছিল না এবং তিনি ছিলেন মাত্র
পাঁচ বছর ক্ষমতায়, ওই পাঁচ বছরেই পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে তিনি অনেক বেশি উন্নয়ন করেন। বাঙালির আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে
সবচেয়ে ভালো সময় ছিল হুসেন শাহি রাজত্ব। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব তখন এবং তখনই সংস্কৃত, বাংলা ও ফারসি ভাষায় সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও নব্য-ন্যায় প্রভৃতির চর্চা হয়েছে বেশি। এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ছিল যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। ঠিক এখন স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স যত, অতটা সময়ই শুধু হুসেন শাহি সুলতানরা শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন কোনো এমডিজি কর্মসূচি ছিল না।
প্রতিটি সরকারকেই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কিছু উন্নয়ন করতেই হয়। সেটা কুতুবউদ্দিন আইবেক করেছেন, কর্নওয়ালিশও করেছেন, কার্জন করেছেন, নূরুল আমীনও করেছেন, আতাউর রহমান খান ও মোনায়েম খানও করেছেন। এমডিজির মেয়াদ শেষ। এখন আসছে তার চাচাতো ভাই স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা—সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)। ওই জিনিস খুব ঘটা করে ঘোষিত হতে যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ম্যানহাটন দ্বীপের অতি উঁচু ভবনে। ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে যাচ্ছেন আরও বহু জ্ঞানী-গুণী ও দেশহিতৈষী। পশ্চিমা দাতারা গুণগ্রাহী। নিশ্চিতভাবেই বলা
যায়, ২০৩০ সালে আওয়ামী লীগের বিপরীত আদর্শের কোনো সরকারও যদি ক্ষমতায় থাকে, তখনো বিশ্ব সংস্থার কর্তাদের থেকে চিঠি আসবে: বাংলাদেশের এসডিজি অর্জনে সাফল্য প্রচুর। এই জাতীয় প্রশংসাপত্র সংশ্লিষ্ট সংস্থার বাধ্যতামূলক কর্মসূচির অংশ।
যে এসডিজি বিধিপত্র ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তাতে ধারণা করি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলা হবে, তোমরা যদি গরিবি দূর করে বড়লোক হতে চাও তো রপ্তানি শিল্পের উন্নতি বাড়াও। দেখবে, তোমাদের জিডিপি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। একুশ হলো জিডিপি বাড়ার শতাব্দী। জিডিপি বাড়ালেই সব হয়ে গেল। শান্তি চলে যাক, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হোক, জীবনের নিরাপত্তা বলতে কিছুই
না থাকুক, রাস্তাঘাটে নারী গণধর্ষিত হোক, গাছে বেঁধে শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হোক, শিক্ষিত বেকারে ভরে যাক দেশ—শুধু জিডিপি বাড়ুক। সেটার নামই স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট।
পরিবেশ ধ্বংস হবে বলে ধনী দেশগুলো তাদের ভূখণ্ডে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে চাইছে না। গরিব দেশকে বলছে রপ্তানি শিল্প বাড়াও। কোনো কোনো গরিব দেশ যেখানে কৃষি অনগ্রসর, জমি অনুর্বর, কৃষি উৎপাদন খুব কম, অথচ জনবল রয়েছে, সেখানে রপ্তানি শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রেসক্রিপশন কিছুটা উপকার করতে পারে। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান উর্বর জনবহুল দেশে তা প্রয়োগযোগ্য নয়। এখানে রপ্তানি শিল্পে দেশ ভরে ফেললে নিশ্চয়ই জিডিপি বাড়তে পারে, তবে সেই সম্পদ গিয়ে জমা হবে অল্পসংখ্যক বিত্তবানের ঘরে। এবং লাভবান হবে সেসব বহুজাতিক করপোরেশন ও কোম্পানি, যাদের কাজ উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া। অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোও, যারা আমাদের ‘উন্নয়নের জন্য’ দয়াপরবশ হয়ে ঋণ দেয়, বেলুনের মতো ফুলে উঠবে।
মোটামুটি খেয়েপরে চলে যাচ্ছে এমন এক পরিবারে গিয়ে যদি কেউ বলে, আপনাদের বাড়ির আম-জাম-কাঁঠাল ও বকুলগাছগুলো সব কাটেন, উঠানে একটা কারখানা দেন, তারপর দেখবেন আগামী দুই-তিন বছরে কত টাকা আসে। এই পরামর্শে যদি ওই পরিবারের কর্তা তা-ই করেন, তাহলে তাঁর আর্থিক অবস্থা অবশ্যই কিছুটা ভালো হবে অল্প সময়ে, কিন্তু তাঁর গাছপালাশূন্য ভিটায় চরবে ঘুঘু। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম হবে গৃহহীন। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন নয়, জীবন হবে অনিশ্চিত।
আমাদের মিডিয়াও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পায়ে ধরে টানাটানিকে গুরুত্ব দেয়। তারা যতটা বাংলার মাটিতে পুঁজি ঢালবে, তার চেয়ে বেশি শুষে নেবে মুনাফা। বাংলাদেশকে বিদেশিদের জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগবান্ধব করার দরকার কী? বিশ্বব্যবস্থা এখন এমন যে আমরা যদি না-ও ডাকাডাকি করি, তবু রবার্ট ক্লাইভের মতো তারা এখানে আসবে। বরং তাদের ঠেকানোই দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনা, যা আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। এ দেশে শ্রমিক সস্তা। প্রশাসন দুর্নীতিপরায়ণ। অল্প ঘুষ দিলে বা তদবির করে যা খুশি তা-ই করিয়ে নেওয়া সম্ভব। বিদেশিরা এসে আমাদের সবুজ জনপদে ফ্যাক্টরি বানাবে। বয়লারে আগুন জ্বলবে সারা দিন। ধ্বংস হবে গাছপালা, কৃষিজমি; ধ্বংস হবে নদ-নদী, খাল-বিল; দশ হাজার বছরের সুন্দরবন। বর্জ্যে ভরে যাবে জনবসতি। একশ্রেণির মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। জাতির কী লাভ?
আমরা কৃষিপ্রধান জাতি। আমাদের সভ্যতা কৃষিসভ্যতা। আমরা মালকোঁচা মেরে নেমে পড়লেও হাজার বছরেও শিল্পোন্নত দেশ হতে পারব না। আমরা জার্মান, ব্রিটিশ বা ফরাসি হতে পারব না। আমাদের যুদ্ধজাহাজ বানিয়ে বিদেশে রপ্তানির দরকার নেই। আমরা নদীতে চলার মতো সস্তায় নৌকাটা যদি বানাতে পারি, তাহলেই কাফি। আমাদের যেকোনো পরিকল্পনা নিতে হবে সবই কৃষিজমিকে রক্ষা করে—ধ্বংস করে নয়।
সমস্যা থাকবে। একটির সমাধান হতে না হতেই আরেকটি আসবে। চিরকাল কোনো জাতির একই রকম সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় না। ১০, ২০ বা ৫০ বছর পরে জাতি সম্ভাব্য কী সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে, তা বিবেচনা করাই দূরদর্শী জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব। আর অদূরদর্শী অসৎ ও অযোগ্য নেতাদের কাজ জাতির যা-ই হোক, নিজেদের তাৎক্ষণিক কী লাভ হলো, সেটা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকা। অদূর ভবিষ্যতের বহু অমঙ্গলের আলামত সাধারণ নাগরিকদের। চেতনার অ্যানটেনাতেই ধরা পড়ে।
এই গ্রহের এক ইঞ্চি জায়গাও এখন ঝুঁকিমুক্ত নয়। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে একটি শঙ্কার কথা নিবেদন করতে চাই। বিভিন্ন ব্যর্থ রাষ্ট্রের শরণার্থীদের নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। সমস্যা শুরু, সহজে শেষ হবে না। আমরা খাতিরজমায় আছি এই মনে করে যে অত দূরের আগুনের আঁচটিও আমাদের লাগবে না। আমাদের এই ধারণা বোকা লোকের। বাস্তবতা ভিন্ন। আগুন লাগানো যত সহজ, প্রচুর পানি ঢেলেও নেভানো তত সহজ নয়। শরণার্থীদের এই স্রোত বইতে থাকবে, তা পশ্চিমা গোয়েন্দারা বুঝতে পারলে আমেরিকার দুর্দিনের বন্ধু দেশগুলো পেন্টাগনকে সাবধান করে দিত: মিয়া ভাই, পাগলা হাতিকে বেশি খ্যাপাইবেন না। ইসলামি জঙ্গি হোক বা অনৈসলামিক জঙ্গি হোক, তাদের তৈরি করা যত সহজ, নির্মূল করা ততই কঠিন।
আমাদের প্রায় এক কোটি লোক মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে থাকে। এসব শরণার্থী সমস্যায় তাদের কপাল ভাঙতে পারে। তাদের কপাল ভাঙা মানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশেরই কপাল ভাঙা। নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক কারণে সাদা চামড়ার মানুষদের পশ্চিমারা দয়া করবে, শ্রমিকও তাদের দরকার, আমাদের রোগা-পটকা বেঁটেখাটো কালো চামড়ার একজনও কোথাও ঠাঁই পাবে না। এখন আমরা রেমিট্যান্সের অঙ্কটা বলে যে ফুটানি করি, ২০২০ সালে তা আর হয়তো করতে পারব না। বহু মানুষ সবকিছু হারিয়ে জন্মভূমিতে ফেরত আসবে। তারা হবে সর্বহারা। তাদের সামাল দেওয়া ১৪-দলীয় বা সাড়ে ২২-দলীয় এমনকি ১১০-দলীয় জোটের কোনো সরকারের পক্ষেও সম্ভব হবে না। সম্ভাব্য ওই অবস্থা নিয়ে সরকারকে গত দুই মাসে কোনো বৈঠক করতে সন্ধ্যার সংবাদে শুনিনি।
বিশ্বের অবস্থা সঙিন আকার ধারণ করছে। অবস্থা বুঝে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে ব্রিটিশ শাসনের পরবর্তী ৬৮ বছরের সব অর্জন বিসর্জন দিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷