অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি এবং মানুষের সহ্যসীমা

মধ্যরাতে আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবারই প্রথম নয়। আমার নিজেরই কয়েক বছর আগের একটি লেখাতেও মধ্যরাতের বিষয় দেখছি। সেখানে আছে, ‘জনমত ও যুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে, বিকল্প সমাধান চেষ্টা না করে বছরের শুরুতে (৩ জানুয়ারি ২০১৩ মধ্যরাত) আবারও তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। বাজেট প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, সরকার প্রতিষ্ঠিত এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে হয় পাশ কাটিয়ে, নয়তো প্রভাবিত করে অযৌক্তিকভাবে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম উপর্যুপরি বৃদ্ধির ফলাফল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সরাসরি আক্রমণ করার শামিল। এসব সিদ্ধান্তে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী খুবই লাভবান হয় সন্দেহ নেই, কিন্তু জনগণের ওপর বহুমাত্রিক বোঝা তৈরি হয়। পণ্য পরিবহন ও জনপরিবহন ব্যয়, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপ তৈরি হয়। বাড়িভাড়া বাড়ে। লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে পতিত হয়। মধ্যবিত্ত, সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য বাজেট কমাতে হয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়, নারী ও শিশুর চিকিৎসা আরও সংকুচিত হয়, ঋণ বাড়ে, প্রতিদিনের জীবন কঠিনতর হয়।’

এই ধারার কোনো পরিবর্তন হলো না। করোনার এত বড় ধাক্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখনো না। করোনাকালে নতুন দরিদ্র হয়েছে দেশের তিন কোটির বেশি মানুষ। করোনা–পূর্ব ও করোনাকালের জটিলতায় দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই এখন কাজ, আয়, অসুস্থতাসহ নানা সংকটে। এর মধ্যে সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সর্বত্র মানুষের প্রশ্ন ‘আমরা কী করে বাঁচব’ কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকার বলে কিছু নেই। কিন্তু মানুষের ওপর জুলুম ও নতুন নতুন বোঝা চাপাতে সরকার খুব চাঙা। তাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ডিজেল, কেরোসিন, এলপি গ্যাসের একের পর এক মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে।

দুটো যুক্তি খুঁজে বের করা হয়েছে মধ্যরাতে মূল্যবৃদ্ধির পর। একটি হলো বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, সরকারের কী করার আছে? আরেকটি যুক্তি হলো ভারতে ডিজেলের দাম বেশি, সে কারণে পাচার হতে পারে সেটা ঠেকানো। এটা ঠিকই যে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বাড়ছে। মন্ত্রী এর সূত্র ধরে বলেছেন, ‘আমরা তো দাম বাড়াইনি, সমন্বয় করেছি।’ তবে এই সমন্বয় তাঁরা যখনই করেন, তখনই দাম বাড়ে। বেশ কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম একদম পড়ে গিয়েছিল। তখন সমন্বয়ের কোনো আগ্রহ চেষ্টা বা যুক্তি মন্ত্রী সাহেবদের দিক থেকে দেখা যায়নি। সে সময় সমন্বয় করে দাম না কমানোতে গত সাত বছরে বিপিসির মুনাফা জমেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখন সরকার যে ভর্তুকির কথা বলছে, তা এই টাকা দিয়েই আরও ২০ বছর চালানো যেত।

এটা ঠিকই যে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বাড়ছে। মন্ত্রী এর সূত্র ধরে বলেছেন, ‘আমরা তো দাম বাড়াইনি, সমন্বয় করেছি।’ তবে এই সমন্বয় তাঁরা যখনই করেন, তখনই দাম বাড়ে। বেশ কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম একদম পড়ে গিয়েছিল। তখন সমন্বয়ের কোনো আগ্রহ চেষ্টা বা যুক্তি মন্ত্রী সাহেবদের দিক থেকে দেখা যায়নি।

কিন্তু ওই মুনাফার টাকা কোথায়? না, বিপিসির হাতে নেই, সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা সরকার সম্প্রতি তুলে নিয়েছে, এর মধ্যে এই টাকাও আছে। কেন? কারণ, সরকারের মেলা খরচ, দেশে সব সেতু, সড়ক, রেলপথ, ভবনসহ সব প্রকল্পের খরচ দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকেও বেশি। দুর্নীতি আর অপচয়ের অনিয়ন্ত্রিত ঊর্ধ্বগতিতে মুহিত সাহেবের ভাষায়, ‘সাগরচুরি’ হতে থাকলে সেই টাকা তো কোথাও না কোথাও থেকে জোগাড় করতে হবে। তা ছাড়া স্যাটেলাইট কিনতে হয়, সাবমেরিন কিনতে হয়, বিলাসী বিদেশ সফরের সুযোগ দিতে হয় তল্পিবাহক লোকদের, আরাম-আয়েশ বাড়াতে হয় সরকারের লোকজনদের। টাকা তো লাগবে। এসবের জন্য সরকার যত জায়গায় সম্ভব কর, শুল্ক, ফি, দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। তাই ডিজেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেওয়া।

ডিজেলে লিটারপ্রতি সরকার দাম বাড়াল ১৫ টাকা। অন্যদিকে প্রতি লিটারে সরকার কর ও ভ্যাট আকারে আদায় করে ১৯ টাকা। তার মানে সরকার শুল্ক কমিয়ে দিলেই আর ভর্তুকি দিতে হতো না, দামও বাড়াতে হতো না। কিন্তু জনগণের জীবন ও অর্থনীতির ওপর চাপ কমত। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধিতে সামনে হয়তো বছরে ভর্তুকি দিতে হতো দুই হাজার কোটি টাকা, সরকার সেটাতে রাজি নয়। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে কয়েকটি কোম্পানিকে বসিয়ে বসিয়ে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা দিতে সরকারের কোনো আপত্তি নেই। বরং তাদের সঙ্গে চুক্তি, দায়মুক্তি আইন সবকিছুর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

ঠিকই যে ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে ডিজেলের দাম বিভিন্ন রকম, সাধারণভাবে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। তাহলে প্রশ্ন হলো ভারতে তো মজুরি-বেতনও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, সরকার কি তা বাড়াবে? ভারত তো এর মধ্যে উল্টো ডিজেলের দাম কমিয়েছে। আর ভারতে যেখানে তেলের দাম বেশি, সেখানে ভারত থেকেই কেন তেল আমদানির জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে? ২০১৬ সাল থেকেই এ বিষয়ে কাজ চলছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের বিবিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই দিন ওডিশার পারাদ্বীপে বৃহৎ একটি তেল শোধনাগারের উদ্বোধন করেছেন, যেখানকার উৎপাদনের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে রপ্তানির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে শুধু রপ্তানিই করবে না, সেখানে একটি পুরোদস্তুর ‘বিপণন অবকাঠামো’ গড়ে তুলবে।...ভারতের পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানান, ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারত পেট্রোলিয়াম বা হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়ামের মতো ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি সংস্থাগুলো বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম খাতে লগ্নি করতে ও একটা মার্কেটিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়তে ভীষণ উৎসাহী।’ তারপর এ নিয়ে সমঝোতা চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী ২০২০ সালে ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ নামে অভিহিত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। দেশে তেলের দাম বাড়ালে ভারত থেকে আমদানি করা তেলের দামের কাছাকাছি যাওয়ার সুবিধা হবে। সেটাও কি একটা কারণ?

নিজেদের গ্যাস ও ক্রমান্বয়ে দাম কমতে থাকা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর ভর না করে ঋণ করে সুন্দরবনসহ উপকূল বিনাশ করে কয়লাবিদ্যুৎ এবং দেশে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে উচ্চ ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে গিয়ে বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে। সরকার এগুলো বাদ দেবে না, বাড়াবে জনগণের ওপর বোঝা।

যাহোক, সরকারের পরিকল্পনা বেশ গোছানো। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পরই শুরু হলো ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে বাস-ট্রাক ধর্মঘট, পরে লঞ্চ ঘাট থেকে ‘সরিয়ে নেওয়া’। বোঝাই গেল সাজানো নাটক, ভালোভাবেই মঞ্চস্থ হলো। কারণ, সব তো নিজেরা নিজেরাই, বাসমালিক-লঞ্চমালিক তো সরকারের লোকজনই। তেলের দাম বাড়ানোর পরে যে বাস-ট্রাকভাড়া বাড়াতে হবেই, এটা তো জানা কথাই। তবে সাজানো নাটকে সরকার ‘নিরুপায়’। একটু ধর্মঘট, তারপর আলোচনা, তারপর দাবি মেনে নেওয়া। ডিজেলের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তার তুলনায় বেশি হারে বাড়বে পরিবহনভাড়া; যারা ডিজেল ব্যবহার করে না, তারাও ভাড়া বাড়াবে। কাগজে যা থাকবে, আসলে বাড়বে তার চেয়েও বেশি। সরকার তখন কিছুই করবে না।

তবে এখানেই শেষ নয়, সামনে সরকারের আরও উপহার আছে। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়বে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। তখনো দাম সমন্বয়ের যুক্তি আসবে, সরকারের ভর্তুকির যুক্তি আসবে। কিন্তু যা আড়াল করা হবে, তা হলো সরকার দেশের সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ না দেওয়ায় নতুন গ্যাস অনুসন্ধানও উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আমদানি করা হচ্ছে বেশি দামে এলএনজি। এ কারণে গ্যাসের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিছু কোম্পানিকে বসিয়ে খাওয়ানোতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। নিজেদের গ্যাস ও ক্রমান্বয়ে দাম কমতে থাকা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর ভর না করে ঋণ করে সুন্দরবনসহ উপকূল বিনাশ করে কয়লাবিদ্যুৎ এবং দেশে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে উচ্চ ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে গিয়ে বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে। সরকার এগুলো বাদ দেবে না, বাড়াবে জনগণের ওপর বোঝা।

সব বোঝা আর দুর্ভোগের জন্য জনগণ। বহু দেশে করোনাকালে মানুষের আয় সমর্থনসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সরকারের আওতায় থাকা জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছে। বাংলাদেশে সরকার এসব কাজে নেই, শুধু নিজের ঢোল পেটানো, দেশে-বিদেশে অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপনী প্রচার করা। আর মেগা প্রকল্পে মেগা চুরির টাকা তুলতে মানুষের পকেটে একের পর এক হাত ঢোকানো।

সরকার যেন পরীক্ষা করছে বাংলাদেশের মানুষের সহ্যসীমা। বাংলাদেশের মানুষের সহ্যসীমা অনেক, কিন্তু তা অসীম নয়!

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

    [email protected]