অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে কামারের ‘নীল মুকুট’

কামার আহমাদ সাইমনের একটা স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রযাত্রা আছে, সেটা তাঁর প্রথম ছবি শুনতে কি পাও! দেখেই টের পেয়েছি। শুধু বিষয় নয়, চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব ভাষা তৈরির চেষ্টা আছে তাঁর। বহুল আলোচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘আইলা’ নিয়ে সে ছবি। কামার আইলায় বিধ্বস্ত সেই জনপদের বেদনা ও শক্তিকে যে মমতায় ক্যামেরায় বন্দী করেছেন, তা পূর্বধারণার আয়নাকে ভেঙে দেয়। সেই ধারারই আরও একটি পরিণত চলচ্চিত্র নিয়ে কামার এবার হাজির হয়েছেন। সারা আফরীন প্রযোজিত নীল মুকুট

চলচ্চিত্রভাষার জন্য তো বটেই, ছবিটি মন, ভাবনা দখল করে আছে এর অভিনব বিষয়বস্তুর কারণে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিযুক্ত বাংলাদেশের একদল নারী পুলিশের দেশের নানা প্রান্তিক এলাকা থেকে হাইতিতে পৌঁছার অভূতপূর্ব অভিযাত্রা নিয়ে এ ছবি। শান্তি মিশনের এই নারী পুলিশ দলটিকে কামার ক্যামেরা নিয়ে অনুসরণ করেছেন পুরোটা পথ। কামার এমন এক জীবনযাত্রার ভেতর ক্যামেরার চোখ রেখেছেন, যেখানে সাধারণ্যের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। ফলে এ এক আশ্চর্য ‍উন্মোচন। দুটি অংশ চলচ্চিত্রটির। প্রথম অংশে কতিপয় নারী পুলিশ সদস্যের শান্তি মিশনে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে নানা সামরিক ও বেসামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি এবং দ্বিতীয় অংশে হাইতির শান্তি মিশনে তাঁদের জীবনযাপন।

বাংলাদেশের নারীর প্রচলিত লিঙ্গপরিচয়ের ইট-সুরকি ধসে পড়তে শুরু করে পুলিশ প্রশিক্ষণের দৃশ্য থেকেই। অস্ত্র চালনা, গুলি, বুট, মার্চপাস্ট, লাঠি ইত্যাদির ঘেরাটোপে এক ভিন্ন পরিচয়ের নারীদের মুখোমুখি হই আমরা। কিন্তু সেই রুদ্ররূপের ভেতরেই উঁকি দিতে দেখি দ্বিধা, ভয়, ক্লান্তিও। টের পাই, কামার আমাদের একটা জটিল বয়ানের জন্য প্রস্তুত করছেন। শান্তি মিশনে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বটিকে বহু মাত্রায় পর্দায় উপস্থিত করেছেন কামার। সেখানে উৎকণ্ঠা আছে, কৌতুক আছে, আছে গভীর বেদনার অনুষঙ্গ। যাত্রার আগে বিদেশে ব্যবহারের জন্য ইংরেজি বলতে পারা না পারার দোলাচল, মেডিকেল প্রস্তুতি হিসেবে ইনজেকশন দেওয়া নিয়ে ভীতি, অজানা এক পৃথিবীর প্রান্তে যাওয়ার উৎকণ্ঠা তাড়াতে আড়ালে ছোট্ট পকেট কোরআনে চোখ বুলিয়ে নেওয়া, লাগেজে সামান্য কয় কেজি বেশি নিতে পারার উল্লাস। দীর্ঘ যাত্রার আগে এসব খুব ছোট, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে দর্শককে তাঁদের এই যাত্রার সঙ্গী করে নেন কামার। তারপর কতিপয় ইউনিফর্ম পরা নারী আকুল কান্নায় চোখ ভিজিয়ে একে একে উঠে পড়েন বিমানে।

এরপর দ্বিতীয় পর্বে সেই নারীদের আমরা দেখি গভীর রাতে হাইতির পথে টহল দিতে, দেখি ফরাসি সেনাকর্তাকে মোকাবিলা করতে, অনেক রাতে হঠাৎ ঊর্ধ্বতন বিদেশি কর্মকর্তার শান্তি মিশনের বাংলাদেশ অফিস পরিদর্শনে তটস্থ হতে, গোলাবারুদ পানিতে ভিজে যাওয়ায় উৎকণ্ঠিত হতে। আবার সমান্তরালে হাইতির যোজন যোজন দূরের সেই সেনাক্যাম্পে বসে এই নারী ‍পুলিশ সদস্যদের দেখি ফোনে সামলাচ্ছেন দেশে ফেলে আসা সংসারের নানা খুঁটিনাটি। একধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির এই চাপা ত্রাসের ভেতরও দেখি এই নারীরা রূপচর্চাও করেন, নাচেন, খুনসুটি করেন, বিশেষ করে পুরুষ পুলিশ সদস্যের তাঁদের প্রতি বিশেষ আচরণ নিয়ে মশকরা করেন। দল বেঁধে গল্প করতে করতে কখনো বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যখন একজন সহকর্মী গেয়ে ওঠেন, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...’

চলচ্চিত্রকার তারকোভস্কি চলচ্চিত্র বানানোকে বলেছেন ‘স্কাল্পটিং ইন টাইম’। অসামান্য সম্পাদনায় বহু শত ঘণ্টার ফুটেজ থেকে কামার তেমনি নিপুণ ভাস্করের কাজটিই করেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্য প্রায়ই আমাদের কাছে নেহাত একটি পোশাক হিসেবে মূর্তিমান হন। তিনি যেন ঠিক কোনো মানুষ নন, একটা ইউনিফর্মমাত্র। কিন্তু কামার আমাদের জানান, এই প্রতিটা ইউনিফর্মের ভেতর বস্তুত ঠাসা আছে পৃথক পৃথক গল্প। ইউনিফর্মের ভেতরের সেই মানবিক মাত্রাই পর্দায় তুলে আনেন কামার তাঁর এই নতুন ছবিতে। বিশেষ করে সেই ইউনিফর্ম যদি কোনো নারীর গায়ে থাকে, তাহলে তার গল্পটি হয় আরও জটিল। বিশ্ব নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে যে নারী দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর পথ পাড়ি দিচ্ছেন, তিনি মোটেও তাঁর একান্ত নিজস্ব ঘর, স্বামী, সংসারের দায়িত্বটি দেশে ফেলে যেতে পারছেন না; বরং সেটিকেও বয়ে নিয়ে চলেছেন। ফলে এই দ্বৈত দায়িত্ব নিয়ে এক অস্থির কম্পাস হাতে যেন তিনি পাড়ি দিচ্ছেন এক উত্তাল সাগর। হাইতিতে অস্ত্র হাতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সামরিক জিপে চড়ে যেমন শত্রুর দিকে নজর রাখছেন তিনি, তেমনি সমান্তরালে হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা সন্তান যে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও না খেয়ে আছে, তার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। চলচ্চিত্রের শক্তি এই যে সে কতিপয় আত্মবিশ্বাসী নারীর নিজেদের বহুমাত্রিক ভূমিকা ‘নেগোশিয়েট’ করার মূর্তিমান উদাহরণ চোখের সামনে ‍ফুটিয়ে তোলে।

চলচ্চিত্রকার তারকোভস্কি চলচ্চিত্র বানানোকে বলেছেন ‘স্কাল্পটিং ইন টাইম’। অসামান্য সম্পাদনায় বহু শত ঘণ্টার ফুটেজ থেকে কামার তেমনি নিপুণ ভাস্করের কাজটিই করেছেন। কামারের জন্য এ কাজ বিশেষভাবে দুরূহ ছিল। কারণ, চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর হাতে কোনো চিত্রনাট্য ছিল না। হাতে কোনো গল্প নেই, কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী নেই, নেহাতই একটি চলমান জীবনধারাকে ক্যামেরায় তুলে এনে তার ভেতর থেকে আশ্চর্য এই গল্প ফুটিয়ে তোলা দুরূহ কাজ। কিন্তু আদি, মধ্য, অন্তের গল্পহীন এক জীবনধারার ডকুমেন্টেশনের ভেতর রুদ্ধশ্বাস এক গল্পের মেজাজ তৈরি করেছেন কামার দক্ষতার সঙ্গে।

ছবিটির কমতির কথা যদি খানিকটা বলি, তাহলে বলতে হয়, যে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার আবহ ছবিটির বাংলাদেশ পর্বে দেখি, তা যেন অনেকটাই থিতিয়ে আসে হাইতি পর্বে। বাংলাদেশ পর্বে নারীদের যেমন প্রতি পদে তাঁদের প্রচলিত লিঙ্গপরিচয়কে ভাঙতে দেখি, হাইতিতে গিয়ে আবার যেন অনেকটাই ফিরে যান তাঁদের প্রচলিত লিঙ্গপরিচয়ে। সেখানকার জীবনে ভীতি, আশঙ্কার বদলে যেন অনেকটাই নিরুদ্বেগের। হতে পারে সেটি সেই বিশেষ মিশনের, বিশেষ সময়টির প্রেক্ষাপট। সেই সঙ্গে আমরা এ চলচ্চিত্রে কর্মকর্তা পদের নারী পুলিশ সদস্যদের হাইতিযাত্রার গল্পটি যতটা দেখি, নিম্নবিত্ত কনস্টেবল পদের নারী পুলিশের যাত্রাটি ততটা দেখি না। ফলে অভিজ্ঞতার শ্রেণিমাত্রাটিতে খানিকটা ফাঁক থেকে যায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এ চলচ্চিত্র শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবিকীকরণের চেষ্টা কি না। এসব প্রশ্ন বিবেচনায় রেখেও আমি মনে করি, নীল মুকুট চলচ্চিত্রভাষার প্রশ্নে, বিষয়বস্তুর প্রশ্নে একটি বড় উল্লম্ফন আমাদের চলচ্চিত্র-মানচিত্রে। এটি খুব করে বাংলাদেশে মাটির গল্প বলেই খুব করে আন্তর্জাতিক। দেশে যখন নানা মাত্রায় নারীর অপমানের ঘটনা ঘটছে নিরন্তর, তখন কামার পর্দায় তুলে ধরেন নীল সামরিক ক্যাপ পরা একদল নারীর পাহাড় ডিঙানোর এই আশ্চর্য জীবন। তাঁদের মাথার ওই নীল ক্যাপ আসলে মুকুটই তো। নীল মুকুট।

একাধিকবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির কথা থাকলেও ছবিটি মুক্তি দিতে পারেননি কামার করোনা মহামারির কারণে। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নয়, কোনো তারকাখচিত অনুষ্ঠানে নয়, কামারের ছবিটি অবশেষে মুক্তি পেয়েছে ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীতে নতুন সংযোজিত হওয়া বাংলাদেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে। কামারকে অভিনন্দন।

শাহাদুজ্জামান কথাসাহিত্যিক

[email protected]