অমিক্রন মৃদু ভেবে আপ্লুত হলে আবার বড় বিপর্যয়

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন খুব দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে গত কয়েক সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী এবং অমিক্রন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অমিক্রনের ধরন, বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের দেশে সামগ্রিকভাবে করোনাভাইরাসের কী পরিস্থিতি, সেটা বোঝার দরকার আছে। অমিক্রন সংক্রমিত রোগীর যে সংখ্যা, বাস্তবে সে সংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরও অনেক বেশি। কেননা, আমাদের দেশে করোনার ধরন শনাক্তে জিন বিশ্লেষণের সুযোগ খুব কম। নতুন ধরন অমিক্রনের সঙ্গে ডেলটার সংক্রমণও এখন হচ্ছে।

যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, অমিক্রন ধরনটি অতি সংক্রামক। খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে সাংঘাতিক রকম দ্রুত ছড়াচ্ছে। তবে কিছুটা আশার বিষয় আছে। অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক অসুস্থতার হার কম। আবার অসুস্থ হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কম। কিন্তু অমিক্রনের অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ার যে বৈশিষ্ট্য, তাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বড় চাপ তৈরি হতে বাধ্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অমিক্রন কী রকমভাবে ছড়াচ্ছে, আমরা কীভাবে এটাকে মোকাবিলা করব? করোনা এখন কতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য থেকেই বোঝা যায়।

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা বিবেচনায় দৈনিক শনাক্ত যেখানে ১ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, সেখানে এখন শনাক্ত ৮ শতাংশ। সংক্রমণের হার ক্রমে বাড়বে। তবে এখনো হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর হারটা কম। কিন্তু যেকোনো সময়ই দুটোই বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, কিডনি রোগ, ক্যানসারের মতো অসুখ যাঁদের আছে, তাঁরাও সংক্রমিত হতে থাকবেন। এ ধরনের নাজুক রোগীর ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালের ওপর আবার চাপ বাড়বে। আইসিইউর চাহিদা বাড়বে। অমিক্রন মৃদু সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, এমনটা ভেবে আপ্লুত হয়ে পড়লে আবার বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। আপাতভয়ংকর মনে না হলেও যেকোনো সময় এটি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকে তিন সপ্তাহ পর সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যাবে।

আমাদের জাতিগত একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যখন কোনো ঝাপটা আসে, তখন আমরা সবাই উদ্যমী হয়ে উঠি। কিন্তু ঝাপটাটা থেমে গেলেই সবখানে, সবার মধ্যে শিথিলতা আসে। করোনা সংক্রমণ মাঝে কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল—সবখানেই শিথিলতা চলে এসেছে। আমাদের এ শিথিলতার খেসারত দিতে হতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় উৎপত্তির পর বিভিন্ন দেশে অমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সরকারকে সুপারিশ দেয়। দেশে ১০ ডিসেম্বর প্রথম অমিক্রন ধরনটি শনাক্ত হয়। এত দিন পর গত ১০ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বিধিনিষেধ দেখে মনে হয়েছে, এটা আরোপ করেই যেন দায় সারা হলো। সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা দরকার ছিল, বিধিনিষেধ জনগণ মানছে কি না, সেটা কারা দেখভাল করবে। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, আলেম-ওলামারা জনগণকে সচেতন করতে ও মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এবারও তাঁদের সক্রিয় করা প্রয়োজন। সেটা করতে গেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের যে গুরুতর অভাব রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা এ ক্ষেত্রে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারেন।

সমন্বিত প্রচেষ্টা না থাকলে কাগজে-কলমে যত ভালো বিধিনিষেধ দেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়িত হবে না। আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের দুটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। ১. সমন্বিত কার্যক্রম, ২. মানুষকে সম্পৃক্ত করা। এ দুটি হাতিয়ার ছাড়া কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না।

দৃষ্টান্ত হিসেবে করোনার টিকার প্রসঙ্গ বলা যায়। মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পারায় এ কার্যক্রমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। ৯ কোটি টিকার ডোজ এখন জোগান রয়েছে। কিন্তু টিকা নেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় টিকা কার্যক্রম আরও বেশি গতিশীল করতে হবে। সেটা করতে গেলে জনযোগাযোগ ও জনগণের মধ্যে প্রচার করার বিকল্প নেই।

টিকা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। ইপিআরের সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হতে হবে গণমাধ্যম। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাটা পালন করছে? বেতার, টেলিভিশনে কেন প্রতি ঘণ্টায় করোনা পরিস্থিতি, সরকারের নির্দেশনা, টিকার তথ্য ও টিকার সুফল নিয়ে প্রচার করা হয় না? জনযোগাযোগ ছাড়া আর সব উদ্যোগ অর্থহীন।

আমাদের জাতিগত একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যখন কোনো ঝাপটা আসে, তখন আমরা সবাই উদ্যমী হয়ে উঠি। কিন্তু ঝাপটাটা থেমে গেলেই সবখানে, সবার মধ্যে শিথিলতা আসে। করোনা সংক্রমণ মাঝে কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল—সবখানেই শিথিলতা চলে এসেছে। এর মধ্যে নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোভিড ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ তাঁদের দেওয়া হয়নি। আমাদের এ শিথিলতার খেসারত দিতে হতে পারে। খুব খারাপভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে। ফের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। মানুষের আহাজারি, আর্তি ও সমালোচনার মুখে আবার পড়তে হতে পারে। এর থেকে বড় জাতিগত লজ্জা আর কী হতে পারে?

ভারতসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কোথাও কোথাও রাত্রিকালীন কারফিউ চলছে। টিকার সনদ না থাকলে গণপরিবহনে চড়তে কিংবা রেস্টুরেন্টে খেতে পারছে না। কিন্তু আমরা বিধিনিষেধ ঘোষণা করেই বসে থাকছি, বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই। কাজ না করে উদ্ধার পাওয়ার প্রবণতা সবখানেই গেড়ে বসেছে।

করোনাভাইরাস একবার যখন এসেছে, তখন এর সঙ্গে আমাদের আরও অনেক দিন থাকতে হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কথা বলা যায়। এ ভাইরাস সংক্রমণের ফলে নিউমোনিয়ায় যাতে মৃত্যু না ঘটে, সে জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিবছর টিকা দেওয়া হয়। কোভিডের ক্ষেত্রেও প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

অমিক্রন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের বুস্টার ডোজ টিকা মারাত্মক অসুস্থতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে। বয়স্ক মানুষেরা যাতে টিকাকেন্দ্রে আসতে পারেন, সে জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ থাকতে হবে। অনেকের মধ্যে ধারণা এসেছে, দুই ডোজ টিকা নেওয়া মানেই তাঁরা নিরাপদ। ধারণাটি ভুল। অনেকে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা থাকবেই। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক করা। এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে আমাদের।

ড. আবু জামিল ফয়সাল জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সরকারের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য