আগে বয়স্কদের টিকা নিশ্চিত করুন

করোনার টিকা নিতে লাইনে অপেক্ষায় মানুষ। গত রোববার ঢাকা শিশু হাসপাতালে।ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কোভিড–১৯ টিকার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর করতে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় রেখে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৮ বছর বা বেশি বয়সীরা করোনার টিকা নিতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়।

দেশে টিকা নিবন্ধনের শুরুতে (২৬ জানুয়ারি ২০২১) প্রথমে ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ৫৫ বছরকে কমিয়ে ৪৪ বছর করা হয় টিকাগ্রহীতার বয়স। কিন্তু নিবন্ধন কম হওয়ায় এবং বেশি মানুষকে আওতায় আনতে দ্বিতীয় পর্যায়ে বয়সসীমা ৪০ বছর করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে (৫ জুলাই থেকে) বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর চতুর্থ দফায় বয়সসীমা কমিয়ে ৩০ বছর করা হয় ১৯ জুলাই।

বর্তমানে যাঁদের বয়স ৩০ বছর বা তার বেশি, কেবল তাঁরাই সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে গিয়ে টিকার নিবন্ধন করছেন। আর এখন এ বয়সসীমা ৩০ থেকে নামিয়ে ১৮ বছর করতে যাচ্ছে সরকার। মহামারি মোকাবিলায় সরকার দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। নিঃসন্দেহে অতি দ্রুত এসব মানুষকে টিকার আওতায় আনা দরকার। ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭ জন টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং যাঁরা টিকা গ্রহণ করেছেন, তা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ইতিমধ্যে যাঁরা টিকা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ আর ৩৮ শতাংশ নারী। এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, নারীরা টিকাপ্রাপ্তি বা গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছেন। করোনা এখন সব পর্যায়ে সংক্রমিত হলেও গ্রাম-শহর, জেলা কিংবা বিভাগভেদেও টিকা প্রদানে রয়েছে ব্যবধান।

করোনা সংক্রমণে বিদ্যমান মৃত্যুহার উপাত্ত বিশ্লেষণে লক্ষ করা যায় যে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব কিংবা পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ (২ কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ জন), তাঁদেরই প্রথমে টিকাদানে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। যেকোনো মূল্যে এ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে হবে। চলমান মৃত্যুহার কমাতে এর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে দেশের ৬২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ২০ বছরের ঊর্ধ্বে, যার সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৩১০। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০ অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ, যার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব। সে হিসাবে ১ কোটি ৪০ লাখ ৩৬ হাজার ১৩০ জন সরকারি বিবেচনায় সিনিয়র সিটিজেন। এসব নাগরিকের টিকা প্রদান নিশ্চিত সাপেক্ষেই কেবল ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা উচিত।

করোনা সংক্রমণে বিদ্যমান মৃত্যুহার উপাত্ত বিশ্লেষণে লক্ষ করা যায় যে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব কিংবা পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ (২ কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ জন), তাঁদেরই প্রথমে টিকাদানে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

এ ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে টিকা গ্রহণে বয়স্ক ব্যক্তিরা নানা সমস্যায় পড়ে থাকেন। গ্রামপর্যায়ে টিকা প্রয়োগে জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা টিকার কার্ড পূরণ সাপেক্ষে সহজতর প্রক্রিয়ায় টিকা দেওয়া দরকার। তা ছাড়া সীমিত ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য সহজতর করার বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তা ছাড়া বয়স্কদের মধ্যে যাঁদের কো-মরবিডিটি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কারা টিকা নিতে পারবেন আর কারা পারবেন না, তা মনিটর করতে হবে। বিশেষ করে যাঁরা হৃদ্‌রোগী, ক্যানসারের কেমোথেরাপি নিচ্ছেন এমন রোগী, অ্যালার্জি প্রকট, হাঁপানি বা ফুসফুসজনিত অসুখ কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রয়েছে, এমন রোগীদের টিকা দেওয়া যাবে না, যা মূলত হতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে।

১৮ বছর বয়সী লোকজনের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিম্ন বয়সসীমায় (১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের) টিকা দেওয়া যায় কি না, সেটি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) ফাইজার–বায়োএনটেক উদ্ভাবিত টিকার অনুমোদনের পর মডার্নার ব্র্যান্ড ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের জন্য স্পাইকভ্যাক্স টিকার ব্যবহার এজেন্সি ইএমএ অনুমোদন দিয়েছে।

এ মুহূর্তে কোভিড-১৯–এর পরিপ্রেক্ষিতে জনমিতিক মানদণ্ডকে বিবেচনায় নিয়ে বয়স্ক বা সিনিয়র সিটিজেনদের অতি দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে। টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের টিকার আওতায় আনতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, ইপিআই কর্মী, সিভিল সোসাইটি, এনজিও ইত্যাদিকে কাজে লাগানো এবং ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। টিকা গ্রহণে মৃত্যুঝুঁকি কমায়—এমন বার্তা সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। বয়স্কদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি—সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে হবে। আর টিকা–কূটনীতির মাধ্যমে বিশ্ববাজার থেকে অতি দ্রুত টিকা সংগ্রহ বা দেশীয় বাজারে টিকা উৎপাদনে গুরুত্ব প্রদানের পাশাপাশি জনমিতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দক্ষতার সঙ্গে দেশব্যাপী সঠিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]