আদালতে দুর্নীতির চালচিত্র

.
.

বিচার বিভাগে ‘দ্বৈতশাসন’-এর টানাপোড়েনে দুর্নীতি ও অসদাচরণের মতো অভিযোগ নিষ্পত্তি ও শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত হওয়া থেকে চূড়ান্তভাবে অপসারিত হতে কখনো কখনো পার হয়ে যাচ্ছে পাঁচ-ছয় বছর। আবার সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তের বৈধতা নিষ্পত্তি হতেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতির প্যানেলে এখন নাম আছে এমন কয়েকজন বিচারক দুর্নীতির দায় থেকে ‘অব্যাহতি’ পেতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এবং তাঁদের সতীর্থরা অনেক আগেই জেলা জজ হয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, খুবই ছোট বিচ্যুতির জন্য সন্দেহভাজন একজন বিচারককে নির্দোষ হিসেবে খালাস পেতে দুই বছর লাগছে। আবার একজন বিচারক, যিনি গ্রহণযোগ্য অভিযোগে প্রাথমিক তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরে পুনরায় দৃশ্যমান কোনো তদন্ত ছাড়া অব্যাহতি পেয়েছেন। এমনকি তাঁকে সংবেদনশীল কর্মস্থলে বদলি করা হয়েছে।

বিচার বিভাগে এই দ্বৈতশাসনের মধ্যেও বর্তমান সরকারের শাসনামলে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে সুপ্রিম কোর্টের সম্মতিতে ৬ জন জ্যেষ্ঠ জেলা জজসহ ১৬ জন বিচারককে চাকরিচ্যুত এবং আরও প্রায় ৪৬ জন বিচারকের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্ত হওয়ার পর সম্ভাব্য চাকরিচ্যুতি এড়াতে আরও ৬ জন স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। ওই ৬ জনকে নিয়ে দুর্নীতির কারণে ২২ জন বিচারকের চাকরিচ্যুতি ঘটেছে বলে মনে করে সরকার।

আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি রুলস তাঁকে এখতিয়ার দিয়েছে, তদন্তের পর্যায়ে তিনি যে কারও বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ব্যক্তিগত শুনানি শেষে অব্যাহতি দিতে সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু তিনি এই এখতিয়ার প্রয়োগ করেছেন বলে নজির নেই। তাঁর কথায়, ‘১৯৮৫ সালের সরকারি শৃঙ্খলা আইন প্রয়োগ করে এত বিপুলসংখ্যক বিচারককে চাকরিচ্যুত করে বাংলাদেশ অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী একটি উল্লেখযোগ্য নজির সৃষ্টি করেছে।’

সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক অবশ্য মনে করেন, দুর্নীতিবাজ বিচারকদের চাকরিচ্যুতি বা বরখাস্ত করা নিঃসন্দেহে লঘুদণ্ড। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিম্ন আদালতে দুর্নীতির ব্যাপারে দুদকের হস্তক্ষেপ চোখে পড়ে না।’ উল্লেখ্য, ওই ছয় চাকরিচ্যুত জেলা জজের মধ্যে এ পর্যন্ত দুদক একজনের বিষয়ে মামলা করেছে।

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিচার বিভাগ অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা, এখানে মানুষের আস্থা থাকবে অত্যন্ত দৃঢ়। বিচার প্রশাসনে দুর্নীতি থাকলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। তাই যে ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেখানে নমনীয় থাকা যাবে না। বিচার বিভাগে আপনাকে নৈতিকতা ও ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আমরা আদৌ হস্তক্ষেপ করি না।’

অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্ট ২৭ এপ্রিল ২০১৬ এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, ‘কোন কোন মহল কর্তৃক বিচারককে বিভিন্নভাবে (ফোনে বা অন্যবিধভাবে) প্রভাবিত করার কতিপয় অপচেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তাঁদের গোচরীভূত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

 জ্যেষ্ঠরাই এগিয়ে: দেশে জেলা জজ আছেন প্রায় ২৩৭ জন। কিন্তু এর মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। অথচ এর নিচের পর্যায়ের ১ হাজার ২৬৩ জন বিচারকের মধ্যে অভিযুক্ত আছেন মাত্র ৩৫ জন। সহকারী ও সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ের তরুণ বিচারকেরা তুলনামূলকভাবে অনেক কম অভিযুক্ত হচ্ছেন। ওপরের পদের যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অধিকাংশই প্রচলিত আইনের ৩ক (অসদাচরণ) ও ৩খ (দুর্নীতি) ধারায় অভিযুক্ত। কিন্তু নথিপত্রমতে, তরুণদের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ চাকরিক্ষেত্রের লঘু অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বিদেশে পড়তে গিয়ে আর ফিরে না আসার শৃঙ্খলাজনিত প্রবণতাটিই বেশি।

 অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাম্প্রতিক কালে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয় অন্তত ৫৬ জনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাসংক্রান্ত আদেশ জারি (জিও) করতে বিলম্ব করেছে। সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে তাদের পুনঃপুন তাগাদা দিয়েছেন।

বিচিত্র অভিযোগ: সন্দেহভাজন দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট একমত হতে পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর মতানৈক্যও ঘটেছে।

একাধিক বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কিছুসংখ্যক বিচারক ঘুষ দাবি করছেন এবং রায় দেওয়ার আগে কেউ কেউ মুঠোফোনে আসামির সঙ্গে কথা বলছেন। দুর্নীতির দায়ে ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ জুয়েল রানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের পর তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে খোদ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। এই বিচারককে অবশ্য দ্রুত বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে তিনটি সারসংক্ষেপ তৈরি হয়েছে। একটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি মিলেছে। বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রস্তাবও গেছে সুপ্রিম কোর্টে।

গত ৩ অক্টোবর আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলের একজন জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের নজরে নেন। অভিযোগে বলা হয়, ‘মসজিদ নির্মাণের’ নামে তিনি চোরাচালানি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন মিটিং করছেন, তাঁদের কাছে টাকা চেয়েছেন এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা নমনীয়ভাবে দেখতে অধস্তন বিচারকদের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই বিচারককে তাৎক্ষণিক কম গুরুত্বপূর্ণ পদে সরিয়ে দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর সম্মতি জানিয়েছেন। এ ধরনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত জিএ কমিটি পরে ভূতাপেক্ষভাবে অনুমোদন করিয়ে নেয়।

হাইকোর্ট বিচারপতিদের তদন্ত রিপোর্ট: প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নির্দেশে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী গত এপ্রিলে চট্টগ্রামে ও বিচারপতি জিনাত আরা ঢাকা জজশিপের ১১ বিচারকের কথিত অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত করেন।

২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের আদালতের কতিপয় বিচারকের অনিয়ম চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হন। ওই রিপোর্টে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম ৪ জুন ২০১৬ তিনজনকে জামিন প্রদান ও অপর দুই মহানগর হাকিম ২৪ ফেব্রুয়ারি আরও চার আসামিকে জামিন প্রদানে অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত হন। রিপোর্টে ‘শুধু আসামির কথা শুনে জামিনদানের’ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিন হাকিমের ‘এমন পক্ষপাত দুর্নীতির ইঙ্গিতবহ’ বলে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের এক বিচারককে ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম বারের এক রেজুলেশনের বরাতে ‘রেপুটেড টু বি করাপ্ট’ (দুর্নীতির দুর্নাম থাকা) বলা হয়েছে। ওই তদন্ত রিপোর্টে তাঁদের সবাইকে বদলির সুপারিশ করা হয়। এবং পরে তাঁদের বদলিও করা হয়েছে।

>সুপ্রিম কোর্ট ২৭ এপ্রিল ২০১৬ এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, ‘কোন কোন মহল কর্তৃক বিচারককে বিভিন্নভাবে (ফোনে বা অন্যবিধভাবে) প্রভাবিত করার কতিপয় অপচেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তাঁদের গোচরীভূত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন

১২ ডিসেম্বর ২০১৩ হাইকোর্টের বিচারপতি জিনাত আরা ঢাকার জজকোর্টে কতিপয় হাকিমের বিষয়ে আনীত অভিযোগের তদন্ত করেন। এতে তিনি চারজন বিচারক ও দুজন কর্মকর্তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। এর মধ্যে ঢাকার দ্বিতীয় আদালতের একটি আদেশে ‘ঘষামাজা’র যে অভিযোগ আনা হয়, তা তদন্তে দূষণীয় প্রমাণিত না হলে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

 ঢাকার অর্থঋণ আদালতের এক বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ১৯ জানুয়ারি ২০০৯ ছুটিতে থাকতে তিনি অবৈধভাবে রায় দিয়েছেন এবং সে জন্য তাঁকে শাস্তি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট বলেছে, ‘এটা অত্যন্ত গুরুতর’ এবং তাঁর ‘সততা প্রশ্নবিদ্ধ’। কিন্তু ওই বিচারক পরে অবশ্য অব্যাহতি পেয়েছেন।

দা এবং ওয়েবসাইট: ধর্মীয় উগ্রপন্থী হিসেবে সন্দেহভাজন এক বিচারক গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার পর থেকে বর্তমানে অনুমোদনহীন ছুটিতে গিয়ে ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন। তিনি তাঁর বেনামে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইটে শেখ হাসিনার সরকারকে ভারত ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পুতুল সরকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর অনেক সহকর্মীর মতে, তিনি কিছুটা মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে উগ্রপন্থী লেখা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বিচার চলাকালেও তাঁর এজলাসে বড় ধারালো দা রাখতেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন। অফিস চলাকালে দুটি দা রাখা এবং তা দিয়ে কসাইদের শরিয়তসম্মতভাবে গরু জবাই করার কায়দাকানুন শেখানোর অভিযোগ করেছেন আদালতের দুজন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ওই বিচারক সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর সঙ্গে থাকা দুটি ধারালো দা নিয়ে সৌদি আরবে হজব্রত পালনেরও ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া চলমান আছে।

জামিনের পর মৎস্য শিকার: কক্সবাজারের সাবেক জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা উপার্জন এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান (বরখাস্তকৃত) জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডার তোফায়েল আহমেদের আমন্ত্রণে মৎস্য শিকারে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান আরেকজন জেলা জজ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মো. নুরুল হুদা গত ২৪ জানুয়ারি লিখেছেন, আসামি তোফায়েলের সঙ্গে তাঁর ভূরিভোজ গ্রহণ ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও গুরুতর অসদাচরণ’। ২৫ জানুয়ারির আরেকটি তদন্ত রিপোর্টে তাঁর দেওয়া জামিন আদেশগুলো ‘দুর্নীতির আশ্রয়ে, বিচারিক অসততা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিফলন ঘটেছে, যা সুনির্দিষ্টভাবে দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। ওই বিচারক এখন আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত কর্মকর্তা।

 ফেনসিডিল: তিনি একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। মাদক অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পরিদর্শক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ৫ আগস্ট ২০১৩ অভিযোগ আনেন যে ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ ওই বিচারক কথিতমতে তাঁর কাছে সেবনের জন্য ফেনসিডিল চান। কিন্তু চার বছর পরে তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চান। এমনকি সুষ্ঠু মীমাংসা করবেন বলে লিখিত মুচলেকাও দেন।

অস্ত্র ও ফেনসিডিল: ঢাকার নিউমার্কেট থেকে দুই কার্টন ফেনসিডিল ও অস্ত্রসহ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাভেদ ইমাম (৩২) ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন। পুলিশ বলেছে, তাঁর কাছে ৫৫০ বোতল ফেনসিডিল ও একটি বৈধ অস্ত্র ছিল। ৯ জানুয়ারি ২০১৩ তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হয়ে ইতিমধ্যে তিনি হাইকোর্টে খালাস পান। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেছে সরকার।

কর্মচারীদের যোগসাজশ: ২৫ মে ২০১০ নড়াইলের সাবেক জেলা জজ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এক বিচারকের বিরুদ্ধে এক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ৪ মার্চ ২০১০ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রকাশ্য আদালতে তাঁকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ইত্যাদি অশোভন উক্তি করেন। তখন বিচারক তাঁদের কাছে ক্ষমা চান। আরেকটি দেওয়ানি মোকদ্দমার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বিচারক তাঁর কর্মচারীদের যোগসাজশে এই মামলার বিবাদী পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বেআইনিভাবে ‘তদবিরের অভাব’ দেখিয়ে মামলা খারিজের আদেশ দিয়েছেন। বিচারক বাদীর প্রতিপক্ষগণ দ্বারা অবৈধভাবে লাভবান হন। তাঁরা পরস্পর যোগসাজশে একের পর এক বিভিন্ন মামলায় অদক্ষতা অনিয়ম, অসদাচরণ, দুর্নীতি ও অবিচারসুলভ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

অব্যাহতি ও পুনর্বিবেচনা: কয়েকটি ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতি ‘প্রমাণিত’ হওয়ার পরও দোষী বিচারককে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে টানাপোড়েনের নজির রয়েছে।

 উদাহরণ-১: ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন সাবেক বিচারক ১৪ বছরের এক কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যা মামলার পলাতক আসামিকে আত্মসমর্পণ মাত্রই জামিন ও পরে খালাস দেন। কথিতমতে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে দুই আসামিকে রেহাই দেওয়ার ঘটনা প্রাথমিক তদন্তে ‘প্রমাণিত’ হয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে জেলা জজ এ কে এম আরিফুর রহমান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) তাঁর প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন বরাবর পলাতক আসামি মো. শাবাবের বিরুদ্ধে মৃত ভিকটিম শারমিনকে ধর্ষণ করার বিষয়ে মৃত্যুকালীন ঘোষণাসহ অভিযোগপত্র দাখিল হওয়া সত্ত্বেও ওই আসামিকে আদালতে আত্মসমর্পণের দিনেই জামিন মঞ্জুর এবং শাবাবের বিরুদ্ধে ধর্ষণের উপাদান থাকা সত্ত্বেও অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতিদানের বিষয়টি নিঃসন্দেহে সার্বিক বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট বিচারকের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা এবং দুর্নীতির ইঙ্গিত বহন করে।’ তবে, জানা গেছে যে অভিযুক্ত বিচারক দাবি করেছিলেন বেনামি অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে হেনস্তা করার চেষ্টা হয়েছে। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম আরেকটি বেনামি অভিযোগ হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি তদন্ত করে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এবারও ২১ মে ২০১৫ সুপ্রিম কোর্ট এক চিঠিতে আইন মন্ত্রণালয়কে জানান: ‘প্রেরিত পত্র প্রত্যাহারক্রমে তাঁকে আনীত অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি প্রদানে অত্র কোর্ট পরামর্শ প্রদান করেছে।’

উদাহরণ-২: ঘটনাটি বান্দরবানের এবং অভিযোগকারী ছিলেন বান্দরবানের তৎকালীন জেলা জজ মো. শফিকুর রহমান। বান্দরবানের ওই সময়ের যুগ্ম জেলা জজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। এর মধ্যে ৪০টির বেশি মোকদ্দমা ‘আইনের অপব্যাখ্যা করে’ ডিসমিস করার অভিযোগ আনা হয়। আইন মন্ত্রণালয় অভিযোগ আমলে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানায়, ‘কোনো সুস্থ ও বিবেকবান বিচারকের’ পক্ষে এসব কাজ করা বাঞ্ছনীয় নয়, বিচারিক কার্যক্রমে তাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ। ২৫ নভেম্বর ২০১৪ তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের প্রস্তাব দেয় সরকার। সুপ্রিম কোর্ট একমত না হয়ে তাঁকে অন্যত্র বদলির পরামর্শ দেন। বদলির বিষয় নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে টানাপোড়েন চলার পর ওই বিচারক ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ পদোন্নতিমূলে অতিরিক্ত জেলা জজ হয়েছেন। কিন্তু, তারপরও আইন মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে এক চিঠিতে জানিয়েছে, ‘তাঁর বিরুদ্ধে খোদ জেলা জজ অভিযোগ করেছেন। এর প্রতিকার না হলে বিচার প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।’

উদাহরণ-৩: কক্সবাজারের সাবেক মুখ্য বিচারিক হাকিম দুই পলাতক আসামিকে (অভিযোগমতে তাঁদের কাছ থেকে ৪৮ কেজি গাঁজা উদ্ধার) তাঁদের আত্মসমর্পণের দিনে জামিন এবং অনুরূপ আরেক অভিযুক্তকে মাত্র তিন মাস হাজতবাসের পরে জামিন দেন। তদন্ত রিপোর্ট বলেছে, বিচারক ‘বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে কথিত অবৈধ কর্মকাণ্ডের একটি অভিযোগ আনা হয়। সরকার স্বতঃপ্রণোদিত প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই বিচারককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাতে একমত হননি। অবশ্য তাঁকে অন্যত্র বদলি করে ভিন্ন তদন্তকারী নিয়োগ দেন সুপ্রিম কোর্ট। অভিযোগ ওঠার তিন বছরেও সেই তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। জেলা জজের প্রস্তাবিত প্যানেলে তাঁর নাম আছে।

দীর্ঘসূত্রতায় পার পাওয়া: একজন বিচারক খুনের মামলার আসামির সঙ্গে ২২ বার টেলিফোনে কথা বলেছেন এমন অভিযোগের ‘প্রমাণ’ পাওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতায় কেটে গেছে বছর তিনেক। তিনি এখন ডিসেম্বরে অবসরে যাচ্ছেন। (শেষ)

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷