আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের আন্তনদী প্রকল্প

নদীর ভাটিতে অবস্থিত কোনো রাষ্ট্রের উজানের প্রতিবেশীর সঙ্গে নদীর পানির ব্যবহার এবং প্রাপ্ত পানির অংশ নিয়ে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই এ সমস্যা আছে। নৌপরিবহন ছাড়াও কৃষি, সেচ, পানীয়জলের উৎস, প্রকৃতি, পরিবেশ রক্ষাসহ অনেক ক্ষেত্রে নদী তথা মিঠাপানির বিকল্প নেই। এ জন্য যুগ যুগ ধরে বহুজাতিক বা আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন, রীতিনীতি, প্রথা ও আইন গড়ে উঠেছে, যা মেনে চলা অপরিহার্য। অন্যথায় নদী উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ভাটির রাষ্ট্র অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আন্তর্জাতিক নদী, তার শাখা-প্রশাখা, সংলগ্ন অঞ্চল, ভূগর্ভস্থ পানি—সবকিছুকে একটি পূর্ণাঙ্গ একক হিসেবে বিবেচনা করে নদীর পানি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। নইলে সবার স্বার্থেরই হানি ঘটবে।
কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য গঙ্গার পানি হুগলি নদীতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে পঞ্চাশের দশকে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে ভাটির দেশের জন্য এর সম্ভাব্য ফলাফলের ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষি ও সেচের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে সিন্ধু নদীর পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করলেও পূর্ব পাকিস্তানে গঙ্গার পানি পাওয়া নিশ্চিত করেনি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশকে ১৯৭৪ সালেই কঠিন ফারাক্কা বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। তারপর বিভিন্ন আন্দোলন, কূটনৈতিক তৎপরতা, জাতিসংঘের আহ্বান এবং ভারতের সঙ্গে আলোচনা, একাধিক স্বল্পমেয়াদি সমঝোতা স্মারক এবং ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়ািদ চুক্তি প্রণয়নের মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতার সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান করা হয়। কিন্তু এ ধরনের সমঝোতা বা চুক্তি শুকনো মৌসুমে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে ভাটিতে যে পানিস্বল্পতা ও পরিবেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়, তা নিরসনের বিকল্প নয়। বর্তমানে তিস্তা ও বরাক নদ–নদীর পানি নিয়েও আমরা অনুরূপ সমস্যার আশঙ্কা করছি। তবে যে সমস্যা এখন সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিতে যাচ্ছে, তা হচ্ছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি আন্তনদীসংযোগ খালের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের একাধিক নদীতে প্রবাহিত করার ভারতীয় পরিকল্পনা।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের সমস্যা আন্তর্জাতিক নদী আইনেই সমাধান হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক আইনের প্রখ্যাত পণ্ডিত ওপেনহাইমসহ সব আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞই এই মত ব্যক্ত করেছেন যে আন্তর্জাতিক নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যার ফলে নদী অববাহিকার অন্যান্য রাষ্ট্র বিশেষ করে ভাটির রাষ্ট্র ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। উদ্ভূত কোনো সমস্যা বা বিরোধ উপকূলীয় রাষ্ট্রসমূহ প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদানের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে। সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এই মতবাদের প্রতিফলন ঘটিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক ঘোষণা, প্রস্তাবনা, ঐকমত্য, কনভেনশন, নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, যা এ বিষয়ে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনের সঠিক অবস্থান নির্দেশ করে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক দলিল হচ্ছে: ক. ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতি কর্তৃক হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই মর্মে গৃহীত প্রস্তাব যে নিজ ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার পানির প্রয়োজনীয় ব্যবহারে প্রত্যেক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রের যুক্তিযুক্ত ও ন্যায্য অংশ পাওয়ার অধিকার রয়েছে, যা হেলসিঙ্কি বিধি নামে সুপরিচিতি লাভ করেছে; খ. ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব (UN.Doc.A/ 8730.1973) যার অধীন কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে; গ. অনুরূপ একটি শর্ত যা জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ববিষয়ক সনদেও যুক্ত করা হয়েছে (ধারা-৩০ UN.Doc.A/RES/3281/XXIX, 1974); ঘ. ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব পরিবেশসংক্রান্ত সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা, যেখানে বলা হয়েছে যে এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না; ঙ. ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ-সংক্রান্ত কনভেনশন। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মেনেই এ বিষয়ে অনেক দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারত-নেপাল কসি নদী প্রকল্প চুক্তি (১৯৫৪), গন্দক সেচ ও জলবিদ্যুৎ চুক্তি (১৯৫৯) এবং ভারত-পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি (১৯৬০)।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী অববাহিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পানি ব্যবহার ও পরিবেশ সমস্যার ন্যায়সম্মত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অনেক যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা সফলভাবে কাজ করছে। যেমন—১. মেকং রিভার কমিশন (কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম); ২. কনভেনশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব দ্য রাইন (জার্মানি, ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গ, দ্য নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ড); ৩. নিল বেসিন ইনিশিয়েটিভ (মিসর, সুদান, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, ইরিত্রিয়া) এবং ৪. সেনেগাল রিভার বেসিন ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (গিনি, মালি, মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল)।
গত মে মাসে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী এক বিবৃতিতে বলেন যে ভারত আন্তনদীসংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রসহ কয়েকটি নদ–নদীর পানি দেশের পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলে প্রবাহিত করার কাজ অনতিবিলম্বে আরম্ভ করবে। এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশ চেয়েছিল ভারতের পরিকল্পিত এই প্রকল্প নিয়ে যৌথ নদী কমিশনে আলোচনা করতে। বরাবরই ভারত বলে এসেছে যে আলোচনার সময় আসেনি; কারণ প্রকল্পটি এখনো শুধু ধারণার পর্যায়েই আছে। এখন তো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তাই শুধু এ বিষয়টি নিয়েই জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের সভা আহ্বান করা প্রয়োজন। আন্তনদী সংযোগের মাধ্যমে কয়েকটি নদীর গতিপথ ও পানির প্রবাহ পরিবর্তনের ভারতীয় প্রকল্পের যে বিশালত্ব, আমার জানামতে কোনো আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহ বা গতিপথ পরিবর্তনের এমন কাজ এর আগে কোথাও কোনো রাষ্ট্র এককভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা দূরের কথা, কেউ চিন্তাও করেনি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর উৎস গঙ্গা অথবা ব্রহ্মপুত্র। যদি উজানে এ দুটি নদীর গতিপথ বা পানির প্রবাহ পরিবর্তন করে ব্যাপকভাবে পানি প্রত্যাহার করা হয়, তার ভয়াবহ ফলাফল আমাদের জন্য সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া ভারতসহ পুরো অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এ জন্য ভারতের সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ড্যাম, রিভার অ্যান্ড পিপলের হিমাংশু ঠাক্কারসহ অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞ এই আন্তনদীসংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। উল্লেখ্য, ভারতে কৃষি ও সেচের দৃই-তৃতীয়াংশ এবং পানীয়জলের তিন-চতুর্থাংশ চাহিদা মেটানো হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেলেও নলকূপের উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং বর্ষায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে নদীর পানির ওপর নির্ভরতা আরও হ্রাস করা সম্ভব। আন্তনদী সংযোগের মাধ্যমে নদীর গতিপথ ও প্রবাহ পরিবর্তন করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং কল্পনার বাইরেও অনেক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি এবং ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কতৃর্ক স্বাক্ষরিত ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ডেভেলপমেন্ট বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ-এ নদীর পানি বিষয়ে যেকোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার কথা বলা হয়েছে। আন্তনদীসংযোগ নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করাও জরুরি। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যেকোনো সমস্যা বা বিরোধের ইতিবাচক সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনসচেতনতা ও সমর্থন কূটনৈতিক আলোচনায় সরকার ও রাষ্ট্রের অবস্থানকে শক্তিশালী এবং আলোচনায় সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
অধ্যাপক এম. শাহ আলম : সদস্য, আইন কমিশন।