আফগানদের রক্ষার দায় রয়েছে ন্যাটোর

এদি রামা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপীয় ইহুদিদের বুক আগলে রক্ষা করেছিল আলবেনিয়া। এর বাইরেও আরও কিছু বীরোচিত ইতিহাস রয়েছে দেশটির। কেউই আমাদের নানা-দাদাদের জিজ্ঞাসা করেন না ইহুদিদের হলোকাস্ট থেকে বাঁচাতে তাদেরকে কতটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। কতজনের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল। মুসলমান, খ্রিষ্টান, নাস্তিক-অসংখ্য আলবেনিয়ান এই কাজটিই করেছিলেন। প্রয়োজনের সময়ে বিদেশিদের তারা আশ্রয় দেন। আলবেনিয়ানদের জীবনের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধন্যবাদ জানাই। ইউরোপে আলবেনিয়া এমন একটা দেশ যেখানে বিশ্বযুদ্ধের শুরুর চেয়ে শেষে ইহুদিদের সংখ্যা বেশি ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশের ভেতরের লোকদের হাতে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। সেটা ছিল পুরোপুরি একটা নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন। দেশের মানুষকে শত্রুজ্ঞানে জেল, জুলুম, হত্যা করা হয়েছিল। তালেবানরা শাসনক্ষমতা গ্রহণের পর আজ আফগানিস্তানের যে পরিস্থিতি আমরাও একসময় সে রকম অভিজ্ঞতা পার করেছি। আমরা সেসময় এমন একটা দেশে বাস করেছি যেখানে চারপাশের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর বিরোধী মতের লোক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরে ধরে অত্যাচার করা হয়েছিল। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে ভিন্নমতের লোকদের একই পরিণতি হতে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশের ভেতরের লোকদের হাতে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। সেটা ছিল পুরোপুরি একটা নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন। দেশের মানুষকে শত্রুজ্ঞানে জেল, জুলুম, হত্যা করা হয়েছিল। তালেবানরা শাসনক্ষমতা গ্রহণের পর আজ আফগানিস্তানের যে পরিস্থিতি আলবেনিয়ায় আমরাও একসময় সে রকম অভিজ্ঞতা পার করেছি।

ন্যাটোর সদস্য হিসাবে আলবেনিয়া যেমন অনেক সুবিধা ভোগ করে, ঠিক তেমন বোঝাগুলোও ভাগ করে নেয়। আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমরাই বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ন্যাটোর সব সদস্যকে তাদের দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হবে।

হ্যাঁ, এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো আফগানিস্তানে কি হলো, কেন হলো? সেখানকার ঘটনাবলি ভবিষ্যতে ন্যাটো জোটকে কী রূপ দেবে। এ সব আবেগহীন প্রশ্ন এখনকার জন্য নয়। এখন করণীয় একটাই। একসঙ্গে কাজ করা; যাতে করে বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন রক্ষা করা যায়। আমাদের অবশ্যই উত্তর আটলান্টিক জোটের মূল্যবোধ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এই দেশগুলোর ভিত্তি। এর মানে হচ্ছে, যারা আমাদের ভাবধারায় বিশ্বাসী, তাদের জীবন যখন ঝুঁকিতে পড়ছে, তাদের থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না।

কিছুদিন আগেও, আফগানিস্তানের জনগণকে সহায়তা দেওয়ার প্রধান উৎস ছিল ন্যাটোর সদস্যরা। আমরা এখন তাদের মাথার ওপর থেকে ছায়া সরিয়ে নিতে পারি না। একই সঙ্গে দুই দশক ধরে আমরা আফগানিস্তানে যে নীতি, আদর্শ, মুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সেখান থেকে ফিরে আসতে পারি না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক জোট ন্যাটো এ সব আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যই গড়ে উঠেছে।

আফগানিস্তানের জনগণ ও বিশ্বের মুক্তি কামী লাখো মানুষের চোখে ন্যাটো মেরুদণ্ডহীন সত্তা হিসাবে হাজির হতে পারে না। ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোকে আমাদের ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং আমাদের জন্য সংগ্রামরত মানুষদের আশা, আশ্রয় ও নতুন জীবন দিতে হবে।

আলবেনিয়া তাদের ভাগের শরণার্থীর বোঝা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ন্যাটোর সবচেয়ে গরিব দেশ আলবেনিয়া তাদের বোঝা নিতে পারে তাহলে জোটের অন্যরা কেন তা পারছে না? আমাদের মৌলিক যে দায়িত্ব সেটা না পালন করার পেছনে শক্ত রাজনৈতিক অজুহাতটা কী হতে পারে?

আলবেনিয়া আফগানিস্তানের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সম্মত হয়েছে। কেননা আমরা ন্যাটো জোটের যে কর্তব্য সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা আসলে কারা? ৩০ বছর আগে আমরা ছিলাম আড্রিয়াটিক উপকূলের আফগান। তিরানার ‘লাল তালেবান’দের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। এবং কসোভো যুদ্ধের সময় কারা ৫ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল?

আলবেনিয়া খুব বড় কিংবা ধনী দেশ নয়। ইউরোপের জটিল বাস্তবতা থেকে আমরা আলাদা নই। আমরা জানি অভিবাসন এখনটাতে কী রকম বোঝা তৈরি করে। আমরা জানি অভিবাসীদের ভয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকারে কী রকম প্রভাব তৈরি করে। রাজনীতিকেরা ভোটে জিততে চান। আমরা অন্য দেশের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু যখন আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষেরা জীবন অথবা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, তখন আমাদের পথটা সুস্পষ্ট।

এ সময়ে আমাদের যা করণীয় সেটা করতে ব্যর্থ হওয়ার মানে হচ্ছে, আমাদের নিজেদের ইতিহাসে আবার ফিরে যাওয়া। গত শতকের ট্র্যাজিক অতীত থেকে শিক্ষা নিতে না পারা। এটা হবে গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইরত আমাদের সেনাদের মৃত্যু এবং তাদের আত্মত্যাগ উপেক্ষা করার মতো ঘটনা। তালেবান এবং তাদের নিষ্ঠুরতা ফিরে আসার ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, অশুভ কখনো যায় না।

আলবেনিয়া তাদের ভাগের শরণার্থীর বোঝা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ন্যাটোর সবচেয়ে গরিব দেশ আলবেনিয়া তাদের বোঝা নিতে পারে তাহলে জোটের অন্যরা কেন তা পারছে না? আমাদের মৌলিক যে দায়িত্ব সেটা না পালন করার পেছনে শক্ত রাজনৈতিক অজুহাতটা কী হতে পারে?

অনেক অজুহাত আছে। কিন্তু মানবতার জন্য বাড়ানো হাতের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। ন্যাটোর মূল ভিত্তি হচ্ছে কোনো দেশ আক্রান্ত হলে সে আঘাত সবার ওপরেই এসে পড়বে। এখন আফগানিস্তান ছেড়ে আসায় সেখানে যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে সেটা মোকাবিলার দায়িত্ব সবাইকে একসঙ্গে নিতে হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট: ইংরেজি থেকে অনূদিত

এদি রামা আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী