আফগানিস্তান ন্যাটো জোটকে যে শিক্ষা দিল

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর ন্যাটো সেনাদের প্রহরায় ব্রটিশ নাগরিকেরা কাবুল ছাড়ছেন। ফাইল ছবি।
ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওভাল অফিসে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রান্সআটলান্টিক দেশগুলোর সম্পর্ক আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরানো, ক্ষিপ্র গতিতে তালেবানের কাবুল দখল, সেখান থেকে বিদেশি নাগরিকদের ঝুঁকিপূর্ণভাবে সরিয়ে নেওয়া এবং আফগান নাগরিকদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে ফেলে যাওয়া ট্রান্সআটলান্টিক দেশগুলোর ‘মেজাজ’ খারাপ করেছে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি বাইডেন যেভাবে দেখভাল করেছেন তা ইউরোপীয়দের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই বিষয়টি এবং আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানির আসন্ন ফেডারেল নির্বাচন আটলান্টিক জোটের সদস্যদের মধ্যে আলাপ আলোচনার একটি উপযুক্ত অবস্থা তৈরি করেছে।

চারটি মৌলিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ককে নতুন আদল দিচ্ছে।

প্রথমত, যদিও ট্রান্সআটলান্টিক দেশগুলোর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কই তাঁকে ও তাঁর প্রেসিডেন্ট পদকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছিল (এবং প্রায় পুনর্নির্বাচিত করেছিল)। কিন্তু ট্রাম্পের অনুদার জনতুষ্টিবাদ ইউরোপকেও সংক্রমিত করেছে এবং তা ট্রান্সআটলান্টিক দেশগুলোর উদার গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতাকে ঐতিহাসিকভাবে সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। ট্রান্সআটলান্টিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অভ্যন্তরীণ ঝামেলাকে আজ জন্য চীন, রাশিয়া বা সহিংস চরমপন্থার চেয়েও হয়তো বড় হুমকি মনে করা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত বিষয় হলো, বাইডেনের নির্বাচিত হওয়া আটলান্টিকতাবাদকে যদিও পুনরুজ্জীবিত করেছে, কিন্তু মার্কিন আন্তর্জাতিকতাবাদের অভ্যন্তরীণ ভিত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ন্যাটোভুক্ত মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সাততাড়াতাড়ি করে মার্কিন সেনা গুটিয়ে আনাকে অতি উদ্বেগজনক লক্ষণ হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে, বাইডেনের ‘মধ্যবিত্তের জন্য গৃহীত বিদেশ নীতি’র মানে হলো তিনি দেশের অভ্যন্তরে মনোযোগ দেবেন এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন উপস্থিতি গুটিয়ে আনার ধারা অব্যাহত রাখবেন। অধিকন্তু, চীনকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। তার মানে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ও তাদের স্বার্থ রক্ষায় আগের চেয়ে কম মনোযোগী হচ্ছে। এটি ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের নিজেদের সুরক্ষায় আরও বেশি ব্যয় করতে এক ধরনের বার্তা দিচ্ছে।

তৃতীয়ত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেই বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অভিবাসন সংকট, ব্রেক্সিট, মহামারি এবং মধ্য ইউরোপের রক্ষণশীল ও অনুদার সরকারগুলোর একগুঁয়েমির মুখে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সংহতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র আরব দুনিয়া থেকে একের পর এক তার উপস্থিতি গুটিয়ে আনছে। এই অবস্থায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোকে লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং নাগরনো-কারাবাখের মতো জায়গায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হবে।

চতুর্থ পরিবর্তন হলো, চীনের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দেশটির আন্তর্দেশীয় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বদৌলতে বৈশ্বিক দিকে তাঁর ক্রমাগ্রসরতা। আটলান্টিক জোটের এক সময় যে বস্তুগত এবং আদর্শিক আধিপত্য ছিল তা এখন আর নেই এবং সেই আধিপত্য বিস্তারের মনোভঙ্গিকে তারা এখন আর উপভোগও করে না। ফলে এই জোটকে এখন তার কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করে চলতে হবে।

এই পরিবর্তিত বৈশ্বিক দৃশ্যপটে নিজের কেন্দ্রীকতা এবং সংহতি রক্ষা করার জন্য আটলান্টিক সম্প্রদায়কে বেশ কয়েকটি লক্ষ্য অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে নিজেদের মধ্যকার অনুদার জনতুষ্টিবাদকে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে মানতে হবে। তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই এই অঞ্চল থেকে জনতুষ্টিবাদকে তাড়াতে হবে।

ন্যাটো এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যকার নিরাপত্তা যোগাযোগকে বাস্তবতানির্ভর করে তুলতে হবে। ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা, বিশেষ করে জার্মানিকে প্রতিরক্ষা বোঝার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বহন করতে হবে এবং ন্যাটো সদস্যদের সামরিক সক্ষমতা নবায়ন করতে হবে। মূলত ন্যাটোর ইউরোপিয়ান ভিত্তির সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানিকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র আরব দুনিয়া থেকে একের পর এক তার উপস্থিতি গুটিয়ে আনছে। এই অবস্থায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোকে লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং নাগরনো-কারাবাখের মতো জায়গায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হবে। আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও সক্ষম ইউরোপের সঙ্গে তখন যুক্তরাষ্ট্রের আগের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত সম্পর্ক হবে এবং এতে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক অনেক জোরালো হবে।

ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধার যত সহজসাধ্য ও ‘বিনা মূল্যে’ হবে ইউরোপিয়ানরা তত আত্মবিশ্বাস হারাবে।

এতে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন ইস্যুতে আটলান্টিক দেশগুলোকে এক হতে হবে। বিশেষ করে চীনে মানবাধিকার নিশ্চিত করার দাবিকে সামনে রেখে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। চীন ইস্যুতে তাদের ঐক্যকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানাবে। এতে এই দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদার হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

গুথাঁ হেলমান ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যাটে ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও শার্ল এ. কাপচান জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক