আফগান মহাবিপর্যয়ে সবাইকেই ভুগতে হবে

আফগানিস্তানে এখন শীত মৌসুম চলছে। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে, খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে
ছবি :এএফপি

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর নাটকীয় প্রত্যাহারের পর চার মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় বিশেষ বিমানে করে, অভিবাসন নীতি শিথিল করে ও অর্থ ছাড় করে কয়েক হাজার ভাগ্যবান আফগান নাগরিককে সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা সেখানে থেকে গেছেন, তাঁরা তালেবান সমর্থক হোন আর তালেবানবিরোধী হোন, বাকি বিশ্ব তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে বিভিন্ন দেশের সরকার আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে রেখেছে, বন্ধ করে দিয়েছে বাণিজ্য। গত ২০ বছরে বিশ্বজুড়ে যে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনকানুন হয়েছে, সেটা প্রয়োগ করেই এটা করা হয়েছে। এর ফলে সেখানকার চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না, অর্থনীতি টলটলায়মান। অনেক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থাকে তাদের প্রকল্প বাতিল করতে হয়েছে, না হয় সেগুলো খুঁড়িয়ে চলছে।

আফগানিস্তানে এখন শীত মৌসুম চলছে। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে, খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। আফগানিস্তানের মানুষের যখন বেশি করে সহযোগিতার প্রয়োজন, সে মুহূর্তেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হচ্ছেন। তালেবানরা সেখানকার শাসনক্ষমতা নেওয়ায় জনগণকে এত বড় মূল্য দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থার কর্মী ও আফগানিস্তানের মানবিক কর্মীরা খাদ্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখা, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু রাখা ও বিদ্যালয়গুলো খোলা রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জ এখন পাহাড়সম। আফগানরা এখন নিঃস্ব, দুর্ভিক্ষের মুখে। এই অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে পুরো দেশই চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়বে। শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ এত গরিব হয়ে যাবে যে সহযোগিতা ছাড়া তারা আর বাঁচতে পারবে না।

উন্নত দেশগুলো ও বাকি বিশ্ব শুধু নিজেদের দরজা বন্ধ করে এই পাহাড়সম মানবিক বিপর্যয় এড়াতে পারবে না। মৌলিক নৈতিকতার বিষয়টাকে পাশে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আফগানিস্তান ধসে পড়লে যে চরম অস্থিতিশীল অবস্থার জন্ম হবে, তার ফলাফল শুধু সেখানকার সীমানাতেই আটকে থাকবে না। অনেক আফগানকেই বেঁচে থাকার জন্য অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হবে। সেখানকার কৃষকেরা মরিয়া হয়ে মাদক চাষে ঝুঁকবে।

আফগানিস্তানের বিদ্যালয়গামী মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক যে সহযোগিতা তাদের বাঁচিয়ে রাখে, সেটা প্রত্যাহার করা মোটেই ঠিক নয়। আফগান চোখে কিংবা পশ্চিমা রজনীতির নিজস্ব স্বার্থে, যেভাবেই দেখি না কেন, সেখানকার পরিস্থিতি দুঃস্বপ্নের মতো। বালুতে মুখ গুঁজে রাখার বদলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো আফগানিস্তানকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলতে তহবিল সংগ্রহে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে—এমন ধারণা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। তালেবান নেতাদের ওপর নেওয়া নিষেধাজ্ঞার উল্টো ফলাফল হিসেবে দাতা সংস্থাগুলোর তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার কিছু লক্ষণ যদিও এখন দেখা যাচ্ছে।

আফগানিস্তানের বিদ্যালয়গামী মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক যে সহযোগিতা তাদের বাঁচিয়ে রাখে, সেটা প্রত্যাহার করা মোটেই ঠিক নয়। আফগান চোখে কিংবা পশ্চিমা রজনীতির নিজস্ব স্বার্থে, যেভাবেই দেখি না কেন, সেখানকার পরিস্থিতি দুঃস্বপ্নের মতো। বালুতে মুখ গুঁজে রাখার বদলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া তালেবান সদস্যদের এড়িয়ে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, অর্থের জোগান নিশ্চিত করা। ২০২২ সালে দারিদ্র্যপীড়িত বেশির ভাগ আফগানকে সহযোগিতা করার জন্য জাতিসংঘ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের তহবিল জোগানের আহ্বান জানিয়েছে। ২ কোটি ১০ লাখ লোকের খাদ্য, আশ্রয়, ওষুধ ও নিরাপত্তার জন্য এ পরিমাণ তহবিল প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ তহবিলের জোগান দিতে পারে। এ ব্যাপারে এ বছরের শুরুতে একটি প্রতিশ্রুতি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রেখেই সেখানে কীভাবে মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রম চালু রাখা যায়, তা নিয়ে একটি কার্যবিধি পাস করেছে জাতিসংঘ। এর ফলে সেখানে দাতা সংস্থার কাজ করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা থাকল না।

দ্বিতীয়ত, দাতাদের তহবিল কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে বিষয়টিতে আরও নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংকের স্থগিতকৃত ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ট্রাস্ট ফান্ডের কথা বলা যায়। সেখান থেকে ২৮০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। এ টাকা ইউনিসেফ ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মাধ্যমে সেখানে খরচ করা হবে। কিন্তু এই শীতে আফগান জনগণকে সহযোগিতার জন্য তহবিল কীভাবে ব্যয় করা হবে, তা নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। দাতারা তাদের তহবিল থেকে চাকরিজীবী এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতনভাতা দিতে পারে। এ সহযোগিতা আফগানদের তাদের দেশে থেকে যাওয়ার আশা জোগাবে।

তৃতীয়ত, আফগানিস্তান ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বেশি বুদ্ধিমান হওয়া উচিত। তালেবানরা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কতটা মানছে, সেটা এখন পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব সম্প্রদায়। কিন্তু তালেবানদের কাছে ঠিক কী প্রত্যাশা, সেটা কিন্তু স্পষ্ট করে তারা বলেনি। ফলে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি তালেবানরা মানবে কি মানবে না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে। তালেবান বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

বিশ্বকে অবশ্যই আফগানিস্তানের জনগণের সংকটে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা আফগান মহাবিপর্যয়ে শুধু আফগানরাই ভুগবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত