আবার 'উই আর লুকিং ফর শত্রুজ'?

বাংলাদেশের এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদা বলে উঠেছিলেন, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।’ এই উক্তি সেই জঙ্গি উপদ্রুত মন্ত্রীকে উপহাসের পাত্র করে তুলেছিল। হলি আর্টিজানে হামলার পরও অনেকের মধ্যেই আদাড়ে-বাদাড়ে ‘শত্রু’ খোঁজার মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অনলাইন-ফেসবুকে যাকে-তাকে জঙ্গি আখ্যা দেওয়াও চলছে। নির্বিচার পুলিশি হয়রানির তলায় পড়ছে অনেক তরুণ, ভাড়াটে আর ব্যাচেলর। অনেকের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও মনে হচ্ছে ‘শত্রু’ এলাকা।
সম্প্রতি জঙ্গি হিসেবে ধৃত ও নিহত বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ থেকেই সমাজে একটা মত দাঁড়িয়ে গেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গি তৈরির কারখানা! অতি সরলীকরণ। সরলীকরণে কিছু একটাকে সত্য বলে ধরে নেওয়ার আরাম আছে, বেশি চিন্তা করতে হয় না। পাশ্চাত্যেও অনেকের মধ্যে এ রকম চিন্তাহীন বিশ্বাস আছে। তারা মনে করে, মুসলমানমাত্রই সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদও চালান হচ্ছে ইউরোপে। এসব চিন্তার পেছনে যুক্তি নেই, তথ্য-প্রমাণও নেই। এফবিআইয়ের হিসাবে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটনা সব সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল ইসলামি চরমপন্থীদের কাজ। বাকি ৭ শতাংশ ইহুদি চরমপন্থী এবং ৬৭ শতাংশ বাম ও লাতিনোদের কাজ। ইউরোপোল রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৫ সালে ইউরোপে ২১১টি সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র ১৭টিতে জিহাদিরা জড়িত, বাকিগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্যদের কাজ। একটা ঘটনার জন্য একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সবাইকে দোষী ভাবা চিন্তার হঠকারিতা।
তেমনি অনেকের বিশ্বাস, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই জঙ্গিবান্ধব প্রতিষ্ঠান। ব্যাপারটা যেন ‘লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার/ গনিয়া দেখিল মর্দ চল্লিশ হাজার’। ‘এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন জঙ্গি ১৬ জন তরুণ নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে বিভিন্ন কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আছেন। পাঁচজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) পড়তেন।’ (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট)। দেখা যাচ্ছে, সমাজের সব স্তর থেকেই উগ্রপন্থী তরুণেরা আসছেন। তারপরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে আলাদা করে ‘সন্দেহভাজনে’র কাতারে ফেলা হচ্ছে! এতে করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাজে স্বাভাবিক চলাফেরার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁরা হয়ে পড়বেন জঙ্গি-আতঙ্কের সহজ টার্গেট। মাথা নিচু করে চলতে হবে তাঁদের। বন্ধু অবিশ্বাস করবেন বন্ধুকে। সন্দেহের বশে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন তাঁদেরই আতঙ্কিত সহপাঠীরা। অনেকেই সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হবেন। এ রকম ঢালাও অভিযোগ ও নিন্দামন্দের চাপে একজন তরুণও যদি সমাজের প্রতি আস্থা হারিয়ে জঙ্গিবাদের দিকে ঝোঁকেন, অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন, অথবা কঠিন শাস্তির মুখে পড়েন; সেই দায় কি আমরা নিতে রাজি?
একটা সময় ছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ‘কোথায় পড়ো’ জিজ্ঞেস করলে থতমত উত্তর আসত: ‘একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও বুয়েটে পড়াকে তখন গর্বের বিষয় ভাবা হতো। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবা হতো বড়লোকের সন্তান। ভাবা হতো, তাঁরা আত্মকেন্দ্রিক, রাজনীতিবিমুখ ও ভোগবাদী। তারপর নো ভ্যাট আন্দোলন হলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ভ্যাট বসানোর সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন কাঁপিয়ে দিল রাজধানীসহ বড় বড় শহরকে। বহুদিনের মধ্যে কোনো আন্দোলন সমাজের সব অংশের সমর্থন পেল। সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা এবং জয় পাওয়া পর্যন্ত একটানা লেগে থাকার সংকল্প দেখালেন ওই শিক্ষার্থীরা। দেশের মানুষের ভালোবাসাও তাঁরা পেলেন। এই প্রথম তাঁরা গর্বের সঙ্গে বলা শুরু করলেন, আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
কিন্তু জঙ্গিবাদী হাওয়া এসে তাঁদের সেই স্বস্তি ও গর্ব মুছে দিল। দুদিন আগে যাঁরা ছিলেন নায়ক, জঙ্গি ঘটনা তাঁদের বানিয়ে দিল ভিলেন। গণমাধ্যমে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন ও মন্তব্য প্রকাশিত হতে থাকল। লজ্জা ও সংকোচ দেখা গেল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায়। কিন্তু আমরা কি এ প্রশ্ন করেছি, গুটিকয়েক জঙ্গি হওয়া দিয়ে লাখো শিক্ষার্থীকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কতটা যৌক্তিক? সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে, এমনকি সরকারদলীয় নেতার ঘর থেকেও তো জঙ্গি আসছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জঙ্গিবাদের কাছে সমর্পিত হননি, তাঁদের কথা আমরা ভুলে গেলাম। তাঁদের নিয়ে যে গর্বিত হওয়া যায়, সেই চিন্তাও আমাদের মাথায় এল না। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণা চলে, বিখ্যাত শিক্ষকেরা যে সেখানে ক্লাস নেন, তা আমরা ভুলে গেলাম। এসব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে না উঠলে দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ ভারতমুখী হতেন, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যেত। মনের দুরবিন আরও জুম করে আনলে দেখতে পাব, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছে লাখো তরুণের জীবনগঠনের সংগ্রাম। দেখতে পাব, সেখানে এখন ধনীর দুলাল-দুলালীদের সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগই উঠতি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আর ধনী পরিবারের সন্তান মানেই সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ নন। অনেকেই জেলা শহর ও গ্রাম-মফস্বল থেকে এসে সেখানে ভর্তি হন। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার চাহিদা মেটাতে পারছে না। রাষ্ট্রও তাঁদের জন্য তেমন কিছু করছে না। কাজে কাজেই তাঁদের পরিবার নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছে।
এই জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত দেশে তরুণেরাই সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। এঁদের ভবিষ্যৎটাই বাংলাদেশ। এঁরা সেই বয়সী, যখন সম্ভাবনা নামক শক্তি, আশা নামক আশ্বাসে ভর করে অনেক অসাধ্যসাধন করা যায়। দেশ এঁদের বুদ্ধি, মেধা, শ্রম, স্বপ্ন ও নেতৃত্ব চায়। তার জন্য অভিযোগ নয়, সহানুভূতি প্রয়োজন। তরুণদের অভিযুক্ত না করে, তাঁদের জন্য মানবিক আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা চাই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ-ইতিহাস-দর্শনের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা দরকার। কেবল এমবিএ-ধারী আর প্রযুক্তিবিদ দিয়ে উন্নত ও মানবিক সমাজ তৈরি করা যায় না। উচ্চশিক্ষাকে বাজারি চাহিদার হাত থেকে যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের ক্রেতা বানানোর শিক্ষা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম আরও মানবিক এবং পরিবেশ আরও গণতান্ত্রিক করার আলোচনাও ওঠানো দরকার। বেসরকারি বা সরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই করপোরেট কায়দায় চালানো যাবে না। এসব না করে, তাঁদের ভিলেন হিসেবে দাগিয়ে দিলে তাঁদের ভিক্টিমাইজেশনই কেবল বাড়বে। আর ভিক্টিম মানসিকতা থেকেই কেউ কেউ বিগড়ে গিয়ে জঙ্গি হয়ে উঠতে পারেন। এমন উদাহরণ অজস্র রয়েছে।
আমরা এক চরমভাবাপন্ন জাতি। আজ আমাদের কাছে যিনি নায়ক, কালই তাঁকে আমরা ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করি না। আমাদের ভক্তি ও ঘৃণা দুই-ই প্রায়শ অন্ধ। আমাদের বরং উচিত ছিল, তরুণদের সন্দেহভাজনের কোটাভুক্ত না করে তাঁদের মন খুলে কথা বলতে দেওয়া। কোন হতাশা, কোন সংকট কিংবা কোন প্রলোভনে পড়ে কেউ সমাজবিরোধী হয়ে ওঠে, তা জানতে উচিত ছিল তাঁদের কাছে যাওয়া। তাঁদের মনের খবর না জেনে কীভাবে আমরা জঙ্গিবাদের অভিশাপ থেকে নিজেদের ও তরুণদের রক্ষা করব? আজ যে আমরা কতিপয় তরুণের ভয়ংকর নিষ্ঠুর ঘাতক হয়ে ওঠা দেখে হতবাক হচ্ছি, তার কারণ এত দিন আমরা বেহুঁশ ছিলাম। আর যে-ই আমাদের হুঁশ হলো, অমনি আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে চারদিকে ‘শত্রু’ খুঁজতে লাগলাম। সর্বত্র শত্রু খোঁজার মানসিকতায় মজে থাকলে এমনই হয়। আমাদের সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বগুলোকে হাড্ডাহাড্ডি শত্রুতাই পর্যবসিত করার চল আছে। ‘আমি’ ও ‘আমরা’ ছাড়া বাকি সবাই শত্রু; এমন চিন্তা সুস্থতার পরিচয় দেয় না। আমাদের শত্রুভাবাপন্নতার চাপে সত্যি সত্যিই যদি অনেক ‘শত্রু’ সৃষ্টি হয়ে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দায়িত্বহীন সমালোচনায় উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি।