আমরা আমরাই তো

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

পাশার মতো খাসা খেলা চাষার জন্য নয়। এই জিনিস রাজরাজড়ার ব্যাপার। খেলতে গেলে ম্যালা পয়সা লাগে। মহাভারতে দ্রৌপদীকে বাজি রেখে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে পাশা খেলেছেন। মোগল সম্রাট আকবর আমির–ওমরাহ আর রাজপুতদের সঙ্গে এই খেলা খেলেছেন। ফতেহপুর সিক্রিতে গেলে আজও আকবরের ‘দিওয়ান-ই-খাসের’ পাশে পাশার বোর্ড দেখা যাবে। 

সেকালের সম্রাটদের যুগ অস্ত গেছে। পাশাও ‘নাই’ হয়ে গেছে। এখন ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান’ পিরিয়ড। পাবলিকের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা সম্রাটদের যুগ। তাঁদের হাতে এখন চরকির মতো এক উত্তরাধুনিক যন্ত্র, পাশার বংশধর ক্যাসিনো। পাবলিকের তহবিল ‘লিক’ করে এই সম্রাটেরা ট্যাঁকে কী পরিমাণ পয়সাকড়ি জমিয়ে ফেলেছেন, তা ক্যাসিনো আবিষ্কারের পর থেকে কায়দামতো জানা যাচ্ছে। 

জায়গার নাম ‘ফকিরেরপুল’, অথচ সেখানে মিলল রাজকীয় জুয়ার আখড়া। কী কপাল আমাদের! আমরা এখন ডাঁটে বলতে পারছি, ‘ফকিরেরপুলে লাস ভেগাসের ছোঁয়া।’ 

পুলিশ আগেই বলেছিল, শুধু ফকিরাপুল নয়, ঢাকা শহরে এ রকম অন্তত ৬০টি ক্যাসিনো আছে। পরে দেখা গেল, ঘটনা সত্য। ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের পর কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, তারপর আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেও ছোট–বড় পরিসরে অভিযান হয়েছে। তার মানে, খালি ধানমন্ডি–মতিঝিলই নয়, ভালোমতো খোঁজ করলে ঠাটারীবাজার কিংবা ভূতেরগলিতেও ভুয়া পথে বসানো জুয়ার আখড়া মিলতে পারে। 

এত দিন ঠিকঠাক চলছিল। আচমকা র‍্যাব-পুলিশ কী সব অভিযান–টভিযান শুরু করাতে ক্যাসিনো নিয়ে ক্যাচাকেচি লেগে গেছে। ক্যাসিনো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসছে টর্চার সেল, ইয়াবা, পিস্তল, কোটি কোটি টাকার বস্তা, এফডিআরের নথি। গ্রেপ্তার হচ্ছেন ক্যাসিনো–সম্রাটেরা। গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তাঁদের চোখেমুখে জীবনানন্দের মতো ‘বিপন্ন বিস্ময়’ খেলা করছে। 

দল ক্ষমতায়, তারপরও হাতে হাতকড়া পড়ছে—দেশে কী শুরু হলো? এর চেয়ে বিস্ময়ের কী থাকতে পারে? 

তাহলে এতকাল ধরে যে তাঁরা জেনে এসেছেন, ‘উন্নয়ন আর দুর্নীতি মাসতুতো ভাই’, সে কথা কি মিথ্যে হয়ে গেল? তাঁরা এত কষ্ট করে ‘হোক উন্নয়ন, হোক দুর্নীতি’ স্লোগানের যে মাহাত্ম্য আমাদের গেলালেন, তা কি সব অর্থহীন হয়ে গেল? তাহলে কি চোরের গেরস্তবিষয়ক দিন গোনা শুরু হয়ে গেল? 

রাজনীতির ঢাল শক্ত বটে, কিন্তু সেটা ১০ মিলিমিটার পুরু কাচের মতো। এমনিতে ব্যাপক শক্ত। নরমাল ঝড়ঝাপটা সহজেই আটকায়। কিন্তু বড় ধরনের বাড়িধুড়ি লাগলে সেই ঢাল ঝুরঝুর করে চুরমার হয়ে যায়। সব আবরু খসে পড়ে যায়। তখন জুয়ার বোর্ড, ক্যাশ টাকা, এফডিআরের নথি, লাল পানির বোতল—সব পাবলিকের নজরে চলে আসে। 

পলিটিক্যাল পার্টিগুলো নিজেদের বল–শক্তি বাড়াতে চাইবেই। সে জন্য তারা নিস্তেজ কর্মী–সমর্থকদের দৃঢ় করতে শত্রুনাশক ও শক্তিবর্ধক নেতা চায়। নেতা বাছাইপর্বে এই বাহুবলী-সম্রাটদের টিকিট দেওয়া হয়। এই বাছাইপর্বেই সম্রাটদের অগ্রাধিকার নির্ণীত হয়ে যায়। তখনই বোঝা যায়, সেই অগ্রাধিকারের তালিকায় রাজনৈতিক নৈতিকতার দাম নেই। দাম আছে সুবিধাবাদের। আমরা এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুশীলনে বহুদিন থেকে অভ্যস্ত। সে কারণেই সম্রাটদের আমরা প্রত্যাখ্যান করি না, বরং নিজের মেয়েকে মারধর করে তালাক দেওয়ার পরও তাঁদের জামাই আদরে মাথায় তুলে রাখি। ‘ফাতরা’ জেনেও তাঁদের যাত্রাপথে পুষ্পবৃষ্টি ঘটাই। সংকীর্ণ পচনশীল স্বার্থপরতায় আপ্লুত হতেই আমরা ভালোবাসি। 

এ কারণেই জুয়াখানা বন্ধে পুলিশের অভিযান চালানোকে আমরা পুলিশ এত দিন তাদের না ধরে আঙুল চুষছিল কি না, সেই প্রশ্ন তুলি। পুলিশ-র‍্যাবকেও ‘অ্যারেস্ট’ করার দাবি তুলি। হঠাৎ করে ক্যাসিনোর বিষয়ে পুলিশের তৎপরতাকে আমরা ‘দলকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখি। ‘বিরাজনীতিকরণের’ চক্রান্ত হিসেবে দেখি। সাংবাদিকেরা কেন এত দিন খবর দিলেন না, সে জন্য তাঁদের চৌদ্দগুষ্টি ধুয়ে দিই। ক্লাবে ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়া খেলা বন্ধ করার মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে ছিনতাইয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত খুঁজি। 

 আমাদের দোষ যে খুব বেশি, তা নয়। কারণ, দীর্ঘ সময় সংবাদকর্মী ও পুলিশের রহস্যময় নীরবতা ও আচমকা ব্যাপক তৎপর হওয়া আমাদের সেভাবে দেখতে শেখায়। পলিটিকসে পলিউটেড হবে আর গডফাদারদের চেইন অব কমান্ড কাজ করবে না, তা তো হয় না। 

ধরা পড়া লোকজন নাকি এখন ক্যাসিনোর পয়সায় ভাগ বসানো লোক হিসেবে যাঁদের নাম বলা শুরু করেছেন, অনেকের মতে তাঁদের নাম মুখে আনা ঠিক নয়। তাঁদের নাম মনে মনে রাখাই নাকি দুরস্ত। 

তা-ই সই। মনে মনেই রাখলাম। ঠগ বাছতে গিয়ে যদি গাঁ উজাড় হয়, তাহলে ঠগ না বাছার পক্ষেই মাথা হেলালাম। আমরা আমরাই তো! 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক