আমরা এত গালি দিই কেন

বাংলায় ‘গালি’ শব্দটি লিখে গুগলে সার্চ দিলে শুরুতেই আসে একটি লিংক। তার শিরোনাম হলো ‘কিছু অসাধারণ বাংলা গালি কালেকশন’। এভাবেই আমরা গালি দিচ্ছি ও গালি দেওয়া শেখাচ্ছি। আমাদের সমাজে গালির ব্যবহারও নির্বিচার। কিন্তু আমরা এত গালি দিই কেন?

গালি সব সমাজেই আছে। ঔপনিবেশিক কারণে পশ্চিমাদের প্রতি আমাদের ভক্তিভাব প্রবল। বিদেশি বলতে আমরা সাদা চামড়াই বুঝতে চাই। তাদের ‘ভদ্র’ ও ‘সভ্য’ বলে মনে করে আমাদের প্রজাসুলভ মানসিকতা। পশ্চিমা সেসব সমাজেও কিন্তু গালি আছে প্রবলভাবে। তাদের ভাষা ও দৈনন্দিন কথাবার্তাতে গালির দেখা হরহামেশা মেলে। এটি বোঝার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষাসফরের প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইটে ইংরেজি ভাষাভাষী চলচ্চিত্র দেখলেই কিছুটা বোঝা যাওয়ার কথা।

কিন্তু আমাদের দেশের গালি সংস্কৃতির সঙ্গে এর ভিন্নতা আছে। এখানে গালির মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে হেয় করার যে সংস্কৃতি কিছুদিন হলো চালু হয়েছে, সেটি বেশ মৌলিক। সবচেয়ে বড় বিষয়, সেই গালিগালাজে যুক্তির ব্যবহার খুব একটা থাকে না। কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের জন্যই সব সময় গালি ব্যবহার হচ্ছে না। অবস্থা হয়েছে এমন, ‘রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, একজনকে দেখলাম, একটা গালি দিয়ে দিলাম।’

এমন পরিস্থিতি আরও সহজে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, অর্থাৎ ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে। এসব প্ল্যাটফর্মে কথা বলতে যেহেতু ট্যাঁকের পয়সা খরচ হয় না খুব বেশি এবং যেকাউকে হাতের আঙুলের নাগালে পাওয়া যায়, তাই কোনো কারণ ছাড়াই যেকাউকে গালি দেওয়ার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয় যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। আর সবচেয়ে কুৎসিত রূপটি দেখার জন্য যেকোনো জনপ্রিয় বা ‘সেলিব্রেটি’ ব্যক্তির ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম পেজ ঘুরে আসা যায়। ঘুরে আসা যায় কোনো সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজের ফিড থেকেও। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, কী অবলীলায় চলছে গালির মহোৎসব! গালি দেওয়া সেখানে ওয়ান-টুর ব্যাপার।

প্রসঙ্গক্রমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। প্রথম খুব বাজে গালি শুনেছিলাম শৈশবে, বাসার জানালার ধারে বসে। এক প্রতিবেশী এক রিকশাওয়ালাকে মা–বাবা তুলে গালি দিচ্ছিলেন। শেষে বিতণ্ডা থেকে জানা গেল, রিকশাওয়ালার অপরাধ ছিল পাদানিতে পা রাখা! কেন আরোহীর সামনে সেখানে পা রেখেছিলেন, তা নিয়েই তাঁকে গালি দেওয়া হয়েছিল।

অবশ্য এ দেশে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গালি দেওয়ার জন্য এই ধরনের তুচ্ছ কারণও থাকে না। গালি, অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার এবং কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটানো এখানে খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কখনো যদি ভদ্রোচিত উপায়েও কেউ এর প্রতিবাদ করেন, তবে তো কথাই নেই। সব ধরনের গালি ও অশ্রাব্য কটু শব্দের গন্তব্য তখন ওই প্রতিবাদকারীর দিকে ধাবিত হয়।

সমাজের মানুষের গালির ব্যবহার ও মানুষের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে বেশ কয়েক বছর আগে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক ছিলেন মনোবিদ টিমোথি জে। নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘দ্য ইউটিলিটি অ্যান্ড ইউবিকুইটি অব ট্যাবু ওয়ার্ডস’। তাতে লেখক বলেছেন, গালি দেওয়াটা অনেকটা গাড়ির হর্ন বাজানোর মতো। রাগ, হতাশা, আনন্দ বা বিস্ময়—এমন আবেগের তীব্রতা বোঝানোর জন্য মানুষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। আবার অন্যের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যও অনেক সময় অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে মূলত অন্যের চরিত্রের ভিন্নরূপ বের করে আনার চেষ্টা থাকে।

জাতীয় পর্যায়ে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ পান না নাগরিকেরা। সরকারের বা রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা করা এখানে কঠিন। হ্যাঁ, কর্তৃপক্ষ বলতেই পারে যে মুখে কে সেলাই দিয়েছে? আক্ষরিক অর্থে সেলাই কেউ করেনি, কারণ সুতোই যে অদৃশ্য। তাতে গণহারে অনেকের মুখেই কুলুপ এঁটেছে। এর একটি প্রতিক্রিয়া যে আমাদের নাগরিক জীবনে ও আচরণে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে?

এ গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, গালিগালাজ বা কটু শব্দ কিছু ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ইতিবাচকও হয়। এতে মানুষ নিজের রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ইত্যাদি নিখুঁত মাত্রায় প্রকাশ করতে পারে। সেই সঙ্গে শারীরিকভাবে আগ্রাসী হওয়ার প্রতিস্থাপকও হতে পারে গালিগালাজ।

আচ্ছা, কোনো দেশের মানুষের মধ্যে যদি জাতীয় পরিসরে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা পুঞ্জীভূত হতে থাকে, তবে? আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এ ধরনের হতাশা বা ক্ষোভ আছে। কারণ, জাতীয় পর্যায়ে এমন ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ পান না নাগরিকেরা। সরকারের বা রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা করা এখানে কঠিন। হ্যাঁ, কর্তৃপক্ষ বলতেই পারে যে মুখে কে সেলাই দিয়েছে? আক্ষরিক অর্থে সেলাই কেউ করেনি, কারণ সুতোই যে অদৃশ্য। তাতে গণহারে অনেকের মুখেই কুলুপ এঁটেছে। এর একটি প্রতিক্রিয়া যে আমাদের নাগরিক জীবনে ও আচরণে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষ যখন স্বাভাবিকভাবে নিজের বক্তব্য ও মনোভাব প্রকাশ করতে পারে না, অবদমিত থাকে, তখনই ভিন্ন পথ বেছে নেয়। আমাদের ক্ষেত্রে হয়তো সেটি অহেতুক গালিগালাজে রূপ নিয়েছে।

বাংলা ভাষার গালিগালাজের আবার লিঙ্গ পরিচয়ও অত্যন্ত প্রভাবশালী। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ একটি জরিপ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি ও তিরস্কারমূলক শব্দ সাধারণত নারীকে অবমাননা করার জন্য ব্যবহার হয়। সংস্থাটির করা ‘সেফ সিটিজেন ফর উইমেন’ নামের ওই জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ নারী রাস্তায় অপমানজনক মন্তব্যের মুখে পড়েন এবং ৪৬ শতাংশ নারী অপমানজনক ভাষার শিকার হন। এবার কিছু বাংলা গালির শাব্দিক বিশ্লেষণ করে ফেলুন, বুঝে যাবেন। তা-ও অস্পষ্টতা থাকলে নিজের পরিবারের নারী সদস্যদের অভিজ্ঞতা জানতে চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য মন তিক্ত হবে বেশি।

অহেতুক গালি দেওয়ার এই প্রবণতা থেকে এ দেশের কিছু মানুষ কবে মুক্ত হবেন, কে জানে। অন্তত এখন পর্যন্ত এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং তীব্রতা বাড়ছে। গালিপ্রিয় স্বদেশিদের প্রতি অনুরোধ, কোভিড-১৯ রোগ থেকে বাঁচার জন্য যখন হাত ধোবেন, তখন সাবান দিয়ে মুখও ধুয়ে ফেলুন দয়া করে। মুখের কথাই আঙুল দিয়ে লেখেন কিনা। কিন্তু মাথার ময়লা যে কোন সাবানে পরিষ্কার হবে, সেটাই ভাবনার।

অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]