
কিশোরী আর গণঘাতকেরা নরম মনের প্রাণী। কিশোরীরা নিষ্পাপ স্বভাববশতই নম্র। গণঘাতকেরা চাতুরী করে নিরীহ ভাব ধরে থাকে। কোথায় তাদের কারণে কত মানুষ মারা গেল, তা জানার ঠেকা তাদের নেই। অবশ্য যেচে পড়ে জানালে দুঃখিত হয়। তারপর আবার নিরীহ-নির্বোধ মুখে সমাজ-সংসারে রাজত্ব করে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিরপরাধের মৃত্যুর দায় নিতে কাউকে দেখিনি।
তৃতীয় দুনিয়ার এক আদর্শ উদাহরণ হলো কারওয়ান বাজার। আলিশান ঝাঁ চকচকে ভবনের নিচেই ভূতপ্রেতের বাসস্থান। তারা আবর্জনার বাক্সমতো বেড়ার তলে ঘুমায়, রাস্তায় রান্না করে। প্রাকৃতিক কর্ম করার প্রয়োজন বোধ হয় তাদের হয় না। হলেও সেই ঘটনার স্থানটা অদৃশ্য। এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সেই রেলে কাটা পড়ল ১০-১২ জন। তাদের চারজন বিনা টিকিটে ইতিমধ্যে পরপারে পৌঁছে গেছে। নাহ, কেউ দুঃখ প্রকাশ করেনি, দায়িত্ব নেয়নি, মাফ চায়নি। রেললাইনের ওপর বসা অবৈধ বাজারের ফেরিওয়ালা, দোকানি, খরিদ্দার—সবাই তো অবৈধই! তাদের জন্য ‘বৈধ’ মহলের জবাবদিহি চাইবে জাতির কোন বিবেক? বিবেকের পাট তো যাত্রাপালার সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়েছে এই দেশ থেকে। অতএব, আইনত ‘কেউ দায়ী নয়’! বাদবাকি যা, তার সবই আহা, উহু, ছি ছি, মানবিক মানবিক!
সাবেক কালে নদী বা সড়কের কোনো জায়গায় নিয়মিতভাবে অপঘাত হলে বিশ্বাস করা হতো, জায়গাটা অপয়া। অদৃশ্য জগতের দেও-দানোরা সেখানে ঘাপটি মেরে বসে ‘মানুষ খায়’। কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ে নিয়মিতভাবে মানুষ কাটা পড়ে। কোনো প্রতিকার নেই, জীবন রক্ষার ব্যবস্থা নেই। রেল কর্তৃপক্ষ মায় সরকার হয়তো বিশ্বাস করে, সবই দেও-দানোর কাজ।
তো দেখতে গিয়েছিলাম সেই দৈত্যপুরী। কালচে হয়ে আসা রক্তের ছোপ। কয়েকটি থেঁতলানো কলা। কলার ঝুড়িটি ঠিকঠাক পড়ে আছে এক পাশে। এর মালিক বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা তৎক্ষণাৎ নিহত। সাত বছর ধরে তিনি এখানে কলা বেচেন। সাত বছর ধরে ট্রেন এলে ঝুড়ি-টুকরি নিয়ে দৌড়ে সরে যান। এবার আর পারেননি। গরুর দুধ বেচেন আবদুল বাসেত। বুড়ো লোকটার সঙ্গে প্রতিদিন কথা হতো: বেচাকেনা কেমন, লাভটাভ কিছু হয় কি না ইত্যাদি। বললাম, ক্যামনে চেনেন ওনারে? বলেন, ‘পথের পরিচয়’।
রেললাইনে সওদা নিয়ে বসা বেশির ভাগ মানুষই পথের পরিচিত। মৃতদের মধ্যে গরিব ক্রেতারাও আছেন। আজ সকালে সেখানে যখন আবার বাজার বসবে, তখন সেই পরিচিতদের কয়েকজন থাকবেন না। হয়তো নিহতদের বসবার জায়গাটা ফাঁকা থাকবে দু–এক দিন। আবারও ট্রেন আসবে জানান না দিয়ে। একইভাবে ভেঁপু বাজবে না। একইভাবে আবারও হয়তো সরে যেতে গিয়ে পড়ে যাবেন কেউ কেউ। তাঁদের ওপর দিয়ে চলে যাবে ট্রেন। পেছনে পড়ে থাকবে থেঁতলানো দেহ, কাটা হাত-পা-মাথা। দৃশ্যে থাকবে থেঁতলানো সবজি বা মাছ। খাদ্য ও খাদকের একই হাল হবে। অনিয়মের ট্রেন চলতে থাকবে।
তুমুল রোদ আর পচা মাছের গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে আবারও দেখব: তেজগাঁওয়ের দিক থেকে একদল লোক আসছে। একটি ১৬-১৭ বছরের ছেলেকে ধরে আছে কয়েকজন, আরও কয়েকজন আনছে বেহুঁশপ্রায় এক নারীকে। ওরা যাচ্ছে কমলাপুরে রেলওয়ের নিজস্ব ডোমঘরে। ময়নাতদন্তের ছুরিতে কাটাফাটা দেহগুলো আরও ছেঁড়াবেড়া অবস্থায় সেখানে পড়ে আছে। মনিরুল যাচ্ছে তার বাবা নূর মোহাম্মদকে আনতে। ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এক আহাম্মক সাংবাদিক তাদের থামতে বলবে, তার ফুটেজ প্রয়োজন। কিন্তু তারা শুনবে না। ব্যস্ততম রেলক্রসিং পেরিয়ে, সোনারগাঁও হোটেল-বিজিএমইএ ভবনের শানশওকত ঘেঁষে, এফডিসির রঙিন হাতছানি পেরিয়ে মৃতের আত্মীয়রা মিছিল করে যেতে থাকবে। কিন্তু কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা-রিকশা পাবে না।
বেশি দূর যাওয়া হয় না তাদের সঙ্গে। আবার ফিরে আসি সেই কলার টুকরির কাছে। কলার কাঁদি কাটার ছুরিটা পর্যন্ত গোছানো। কেবল শরীরটা গুছিয়ে সরে যেতে পারেনি মানুষটা। মৃত্যুর দায় কেউ না নিক, কিন্তু কলাগুলোর কী হবে? মেছো বাজারের কামলা কয়জন সেটা ঘিরে জটলা করছে। বুড়ো কলাওয়ালার কোনো ওয়ারিশ অথবা মোবাইল ফোন মেলেনি তখনো। লাশ অথবা এক টুকরি কলার কী হবে, সেই নিয়ে তারা থতমত।
উল্টা দিকে এফডিসির দেয়াল ঘেঁষে এক সারি সর্বহারা ভাতের হোটেল। তারই একটির বাসনকোসন ধোয়ার জায়গায় গালে হাত দিয়ে বসে একজন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনার কেউ কি...’। চোখ তুলে বলেন সেই নারী, ‘আমারে জিগায়েন না, আমারেও মাইরালান।’ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। তিন দিন আগে, এখানেই এক হোটেলমালিকের ভাই রেললাইনের ওপর গোসল করছিলেন। হয়তো তার চোখ-কানে পানির পর্দা পড়েছিল। তিনি দেখেনওনি, শোনেনওনি। ট্রেন এসে মেরে দিল। এখন তিনি হাসপাতালে।
সামনে দিয়েই হুইসেল বাজিয়ে গেল আরেকটি ট্রেন। ঘণ্টা বাজল, চালক মহাশয় হুইসেলও দিলেন ক্রসিংয়ের ঠিক আগে। কিন্তু তেজগাঁও আর বিজিএমইএর মাঝখানে ধনুকের মতো যে বাঁক; হুইসেল না দিলে সেখানকার কেউই টের পাবে না ঘাড়ের কাছেই ট্রেন। ঠিক এটা ঘটেছে তখন। হাজার হাজার মানুষের বাজার। এক দিকে ট্রেন দেখে তারা আরেক দিকে লাফ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেদিকেও তো আরেকটি ট্রেন। এ অবস্থায় সুপারম্যান না হলে বাঁচা কঠিন। বাঁচেওনি।
রেলের বসদের কর্তব্য ছিল। রেল পুলিশই যেখানে অবৈধ বাজারের বখরা খায়, সেখানে কাকে কী বলবেন? ভাঙারি দোকানের এক মজুর জানালেন, রেলবাজার থেকে প্রতিদিন টাকা তোলেন সিরাজ কমান্ডার নামের এক লোক। এফডিসির দেয়ালঘেঁষা ৪০টি দোকান; এসবের ভাড়াও তিনিই গোনেন। কিন্তু টাকাটা যায় কোথায়? খবরের সুতা ধরে ধরে হাজির হলাম তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে হাজি মকবুল আহমেদের দপ্তরে। তিনি এফবিসিসিআইয়ের সদস্য, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি সমিতির সভাপতি; বিরাট পরিবহন ব্যবসায়ী। তাঁর লন্ডনফেরত ছেলে জানালেন, ফিশ মার্কেটে কিছু জায়গার ইজারা আছে তাঁদের। তবে রেললাইনের বাজারের কথা তিনি জানেন না। জোহরের নামাজ থেকে ফিরে হাজি মকবুল আহমেদ জানালেন, তাঁরা ৪০ জন মিলে রেললাইনের পাশের জায়গা ভরাট করে ৪০টি দোকান তুলেছেন। বছরে দুই লাখ টাকায় ইজারা। তবে তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে চার-পাঁচ বছর আগে। রেলের বাজারের ভাড়া পান? জবাবে ভোরে আসতে বললেন বাজারে। প্রশ্ন জাগে, যে সিরাজ কমান্ডার তাঁর দোকানের ভাড়া তোলেন, তিনিই কেন খোলাবাজারেরও ভাড়ার ঠিকাদার হন? যদি রেলের বাজারের হিস্যা তাঁর না-ই থাকবে, তাহলে ফিশ মার্কেটের ওই জায়গার ভাড়া কেন নেন তিনি? মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পুত্রের প্রথম প্রতিক্রিয়া ‘বাজারের লোকজন অ্যাজ আ পারসন কেয়ারলেস’। আমার চাপাচাপিতে পরে অবশ্য তিনি দুঃখিত হন!
হাজি মকবুল, সিরাজ কমান্ডার, রেল পুলিশ, রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট, দেলু সর্দারসহ বৈধ অনেকেই এই ‘অবৈধ’ বাজার থেকে টাকা পান বটে, তবে মৃত্যুগুলো ‘কেয়ারলেস’ হওয়ার শাস্তিও বটে। আর ক্ষমতাবাজির টাকা-ব্যবসা-মুনাফা? সব নিদায় নিরীহ নিষ্পাপ।
রেল কর্তৃপক্ষ নীরব। রেলওয়ের হাতেই দেশের সবচেয়ে বেশি জমি। যদি বৈধভাবেও ইজারা দেওয়া হতো, যদি জীবন ও সম্পদের ব্যাপারে তারা যত্নবান হতো, তাহলে রেলও লোকসান দিত না, সময়ে সময়ে এত মানুষও কাটা পড়ত না। রেলের কালো বিড়াল কেবল দুর্নীতিই করে না, মানুষও মারে। কাকে দোষ দেব তাহলে? যারা মরেছে তাদের? নাকি সেই অদৃশ্য কালো বিড়ালদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]
আরও পড়ুন :