
কিংবদন্তিতুল্য নায়ক রাজ্জাক অভিনীত একটা ছবি ছিল পাগলা রাজা। ওই ছবিতে রাজ্জাক সাহেব সিংহাসনে দুই পা তুলে বসে নাচানাচি করে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। আমার একটা আকাশকুসুম স্বপ্ন আছে। এই দেশে এই রকম কোনো পাগলা রাজা এসে বলবেন, তোমার শহর পরিষ্কার রাখো। এই জন্য যা করতে হবে, নিজের নিজের বাড়ি, অফিস এবং দোকানের সামনে থেকে ময়লার স্তূপ সরাও। সরিয়ে কোথায় ফেলতে হবে, পাগলা রাজা তা দেখিয়ে দেবেন।
এত নোংরা একটা শহর হতে পারে?
শুধু কি রাস্তায় ময়লা? পুরো দেশ এবং এই দেশের অনেক শহরের বাতাস দূষিত। থকথক করছে ভাসমান কণায়। এবং গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন এই প্রথম আলোতেই বেরিয়েছে, আমাদের শহরগুলোর বায়ুদূষণ বিপৎসীমা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে।
এই শহরের রাস্তাঘাট কি পরিষ্কার করা যাবে না? এই শহরের বাতাস কি দূষণমুক্ত করা যাবে না?
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন একটা অভিযান শুরু করেছেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযান। আপনার শহর পরিষ্কার রাখুন। এমনকি, তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস দিবসে নিজের শহর আর স্বাস্থ্যকে ভালোবেসে শহর পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামতে নগরবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছেন। ফেসবুকে দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় থেকে অধ্যাপক লেখক আলী রীয়াজ দুঃখ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ দিবস। সেটা কি ভালোবাসা দিবসই হয়ে গেল? আমি বলি, ভালোবাসা দিবস হোক আর শহীদ দিবসই হোক, পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করাটা খারাপ কিছু না। বরং এটা দরকার।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ মূলত নোংরা। আমি নিজেকে এর মধ্যে ধরে নিয়েই বলছি। এবং আক্ষরিক অর্থেই আমরা হলাম মাটির সন্তান। পলি পড়ে এই বদ্বীপ গড়ে উঠেছে। জলা-জংলার দেশ। গাছ কেটে একটা জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। তারপর গাড়া কেটে মাটি তুলে খানিকটা উঁচু করে একটা ভিটা তৈরি করা গেছে। ওই ভিটাতে শণের ঘর, খড়ের ঘর তুলে আমরা থাকতে শুরু করেছি। পানির জন্য নদী কিংবা বাড়ির পেছনের পুকুরটি। চলাচলের জন্য খেতের আল। বর্ষাকালে নৌকা। বাথরুমের দরকার ছিল না, ময়লা ফেলার জন্য বাঁশঝাড় তো আছেই। আর পানি নিষ্কাশনের তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের লোকালয় ও জনপদগুলো গড়ে উঠেছে এভাবে। ধানের খেত ভরাট করে আমরা বাড়ি বানিয়েছি। সেখানে যাওয়ার জন্য ছয় ফুট একটা রাস্তা। পরে ওই রাস্তা পাকাও হয়েছে, কিন্তু কোনো ড্রেন নেই, ইলেকট্রিক লাইন নেওয়ার জায়গা নেই, গ্যাস-পানির পাইপ নেওয়ার জায়গা তো কল্পনাতেও ছিল না। ময়লা যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হয়, এটা আমরা জানব কোত্থেকে? সারা শহরের রাস্তাঘাট হলো আমাদের ডাস্টবিন। গাড়িতে বসে বাদাম খাচ্ছে, গাড়ির ভেতরে বাদামের খোসা কেউ ফেলবে না, এই গাড়িতে ফেলছ কেন, নোংরা কোথাকার, রাস্তায় ফেলো। রাস্তা তো আমার বাপ-দাদার। রোজ সকালে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সবুজ ইউনিফর্ম পরে রাস্তা ঝাড়ু দেবে। আর আমাদের কাজ হবে সেই রাস্তায় দুনিয়ার আবর্জনা ফেলা।
আমাদের একটা প্লট আছে। ওটাতে একটা বাড়ি বানাতে হবে। ইট কোথায় রাখা হবে, বালুর স্তূপ করা হবে কোথায়? কোথায় আবার? আমার বাবার রাস্তা আছে না? ফুটপাত আছে না? ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রধান কারণ ভবন নির্মাণে নিয়মকানুন না মানা। আজ থেকে নিয়ম করে দিন, কেউ নির্মাণসামগ্রী নিজের জায়গার বাইরে রাখতে পারবে না। না রেখে যদি নির্মাণকাজ করতে না পারে, করবে না! রাস্তা কারও বাবার না। ফুটপাতও কারও দাদার না। নিয়ম করে দিন, নিয়ম না মানলে শাস্তি দিন, দেখবেন ঠিক নিয়ম মানা হচ্ছে, যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধান আছে। দুই. নির্মাণস্থান না ঢেকে কেউ নির্মাণকাজ করতে পারবে না। দুবাইয়ে, শারজায়, কাতারে ধুলা আমাদের চেয়ে কম নয়, সেখানেও প্রচুর নির্মাণকাজ চলছে, সেখানকার বাতাসে তো ধুলাবালি ভাসছে না!
কিন্তু প্রথম দায়িত্বটা পালন করতে হবে নাগরিকদের। নাগরিকদের সচেতন হতে হবে যে আমরা আমাদের শহর নোংরা করব না। (এই ফাঁকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শাহজালাল বিমানবন্দরের শৌচাগার নোংরা থাকে, বিশেষ করে মেয়েরা খুবই এই অভিযোগ করেন। বিমানবন্দর একটা দেশের প্রবেশমুখ। সেটার শৌচাগার আমরা পরিষ্কার রাখতে পারব না? এটা কোনো কথা? আমরা না মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি! শৌচাগার পরিষ্কার করতে কত টাকা লাগে? আর আমাদের বিমানবন্দরের লাগেজ যাত্রীদের হাতে আসতে বিরক্তিকর রকম বেশি সময় লাগে। ইন্টারনেটে আমরা ভিডিও দেখেছি, লাগেজ যাঁদের ওঠানো-নামানোর কথা, তাঁরা সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। এই দুটো ব্যাপারের সমাধান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করা সম্ভব। হ্যালো, কেউ কি শুনছেন?)
একটা দেশ সে রকম, দেশের মানুষগুলো যে রকম। আমরা নোংরা, তাই আমাদের দেশ নোংরা। আবার সিস্টেম বা ব্যবস্থা ঠিক থাকলে এই মানুষগুলোই কিন্তু নিয়মকানুন মানে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মানুষ সুনামের সঙ্গেই কাজকর্ম করছেন। এখন মানুষ আগে স্বভাব বদলাবে, নাকি ব্যবস্থা বদলানো হবে আগে? দুটোই করতে হবে। তবে অন্যকে দোষ না দিয়ে আগে নিজের দিকে তাকানো ভালো। অন্যে কেন কাজ করছে না, সেটা নিয়ে কথা বলা সহজ, কিন্তু তার চেয়েও সহজ নিজে করছি কি না সেটা দেখা। (সেটা আসলে সহজ না, নিজেকে বদলানোই সবচেয়ে কঠিন।)
মাশরাফি বিন মুর্তজার জীবনী নিয়ে একটা বই বেরোবে এবারের বইমেলায়। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের এই বইয়ে মাশরাফি বলেছেন:
‘আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো।’ মাশরাফি তো সক্রেটিসের তত্ত্ব দিয়েছেন, প্লেটোর সঙ্গে আলোচনায় সক্রেটিস এমন কথাই বলেছিলেন। যার যার নিজের কাজ ঠিকভাবে করাই দেশপ্রেম। আর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও এই একটাই কথা, আসুন, আমরা আজ থেকে পণ করি, রাস্তায় ময়লা ফেলব না। এক টুকরা কাগজও ফেলব না। এক কণা থুতুও ফেলব না। নিজের বাড়ির সামনের অংশটা পরিষ্কার রাখব। নিজের প্রতিষ্ঠানের সামনে ময়লা জমতে দেব না। নিজের দোকানের সামনের ফুটপাত পরিষ্কার রাখব। এবং রিহ্যাব কি ঘোষণা দেবে, তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় রাখবে না? মাটি কেটে মাটি রাস্তায় পালা করবে না। খোলা আকাশের নিচে বালু রাখা হবে না?
প্রথম আলোয় ২৮ জানুয়ারি ২০১৬ বিনোদন পাতায় খবর ছাপা হয়েছে—‘ঢাকায় নাচবেন কারিনা’। অন্তর শোবিজের আয়োজনে ‘ক্লিন ঢাকা কনসার্ট উইথ বলিউড কুইন অ্যান্ড এজে’ শীর্ষক এই আয়োজনে সহযোগিতা করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। আমরা যে নোংরা, আমাদের শহরটাকে যে পরিষ্কার করা দরকার, এটা বোঝানোর জন্য আমাদের মুম্বাই থেকে নায়িকা আনতে হচ্ছে! আর কী বললে বাংলাদেশের মানুষের হুঁশ হবে?
আমি কোনো ভাষা, কোনো সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নই। কারিনা কাপুর অভিনীত থ্রি ইডিয়টস দেখতে আমি শিক্ষার্থীদের পরামর্শও দিয়েছিলাম। আর বাংলাদেশের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে মুম্বাইয়ের নায়ক-নায়িকাদের এনে ঢাকায় অনুষ্ঠান করে আর আমরা সেসব অনুষ্ঠানে চেয়ারে জায়গা না পেলে মাটিতে বসেই দেখি, তাও তো নতুন কোনো খবর নয়। তাই বলে ক্লিন ঢাকা প্রচারণায় কারিনা কাপুর?
টেলিভিশনে ‘ব্রেইন গেমস’ নামের একটা অনুষ্ঠানে একবার দেখানো হয়েছিল, মানুষের মনের ওপরে একটা ভিডিও ছবির কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। একদল মানুষকে দেখানো হলো হইচই মার্কা একটা ভিডিও, হার্ড রক, কার রেসিং, গতি ইত্যাদিতে ভরা। আরেক দল লোককে দেখানো হলো শান্ত একটা ভিডিও ক্লিপিং, ভোর হচ্ছে, নদী বইছে, সঙ্গে সুন্দর শান্তি সংগীত। দুই দলকে এবার বলা হলো, বেলুন ফোলাতে হবে। বেলুন মধ্যম আকারের হলে পাবে ১০০ ডলার, বড় আকারের হলে ১০০০ ডলার। যারা উত্তেজক ভিডিওটা দেখেছিল, তারা সবাই বেলুন বেশি ফুলিয়ে ফাটিয়ে ফেলল। আর যারা শান্ত ভিডিও দেখেছিল, তারা সবাই ১০০ ডলার করে জিতে নিল।
কারিনা কাপুররা আছেন, থাকবেন। কিন্তু আমাদের দরকার পরিশীলন। যতক্ষণ আমাদের মন পরিষ্কার না হচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের শহর পরিষ্কার হবে না। এই শহর আমার, এর গৌরব মানে আমার গৌরব, এর অমর্যাদা মানে আমার অসম্মান—এই বোধ যার নেই, সে কেন শহর পরিষ্কার রাখবে? কারিনা কাপুরদের আনলে আমাদের মন পরিষ্কার হবে না। যারা হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের দেখতে স্টেডিয়ামে ভিড় করেছিল, তারা সেই অনুষ্ঠানেই ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছিল। নিজের লালন-হাসন রাজা-ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি যদি নাও শোনান, তাদের রবিশঙ্কর শোনান, তাদের সত্যজিৎ রায় দেখান। কারিনা কাপুরদের নৃত্য দেখিয়ে শহর পরিষ্কার করা যাবে না।
তবু শুরুটা করার জন্য সাঈদ খোকনকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।