আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘হিরের রংটা’ কি বিবর্ণই থাকবে

বাংলাদেশ যখন নতুন শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তখন শিক্ষার মূল দর্শন মাথায় রেখেই এ কাজ করা বাঞ্ছনীয়। ২০২৭ সাল নাগাদ নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ শেষ হবে বলে সরকার আশা করছে। পরিবর্তিত বিশ্বের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও বিভিন্ন দেশের সফল শিক্ষাব্যবস্থাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ কাজ যদি নীতিনির্ধারকেরা সফলভাবে করতে পারে, দেশের উন্নয়নে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। বস্তুত, উন্নয়নের চেয়েও শিক্ষা বিষয়ে অনেক বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা দরকার। শিল্পকারখানা, উচ্চতর বিজ্ঞান-গবেষণা ও কৃষিব্যবস্থার প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্যও থাকতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়। এ জন্য শিক্ষক, শিক্ষা গবেষক ও শিক্ষা বিষয়ে যাঁদের চিন্তাভাবনা আছে ও উল্লিখিত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া জরুরি।

শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হলো সংস্কৃতিমান মানুষ তৈরি করা। আর সংস্কৃতি হলো কল্যাণচেতনা, শ্রেয়বোধ, সমন্বিত জীবনচেতনা ইত্যাদি গুণের সমাহার। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘হীরের রঙটা হল শিক্ষা আর ওখান থেকে আলোটা ছিটকে পড়ে, তা হল সংস্কৃতি।’ অতএব শিক্ষাব্যবস্থা যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কৃতিমান মানুষ তৈরি করতে না পারবে, ততক্ষণ এর উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।

শিক্ষার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করা। এ জন্যই শিক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়, ছাত্র যাতে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে, সে ব্যাপারে তাকে সহায়তা করা, জ্ঞানের উৎসগুলো বাতলে দেওয়া। শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সরাসরি জ্ঞান প্রদান করতে পারেন সামান্যই। কিন্তু সামান্য জ্ঞান দিয়ে তো জ্ঞানী মানুষ তৈরি করা যায় না। সে জন্যই শিক্ষকের কাজ হলো জ্ঞানের উৎসগুলোর সন্ধান দেওয়া।

জ্ঞানচর্চার একটি বড় বাধা হলো পূর্বধারণা তথা প্রেজুডিস। পরিবার, সমাজ বা পরিপার্শ্ব থেকে যে জ্ঞান শিশুর মনে সঞ্চারিত হয়, তা থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞানের চর্চা করতে হয়। না হলে নতুন জ্ঞান, নতুন ধারণা, তার পূর্বধারণার সঙ্গে সংঘর্ষ লেগে তা ফিরে যেতে পারে। সে জন্যই সক্রেটিসের বক্তব্য প্লেটোর লেখায় আমরা পাই, ‘অপরীক্ষিত জীবন যাপনের যোগ্য নয়’। অর্থাৎ যাচাই না করে জন্মসূত্রে পাওয়া যে জীবনদর্শন ও জীবনপ্রণালি, তা গ্রহণ করা অনুচিত। শিক্ষার আরেকটি উদ্দেশ্য তাই ছাত্রকে প্রশ্নমুখী করা। জন্মসূত্রে পাওয়া দর্শন ও নতুন জ্ঞান বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করতে ও প্রশ্ন করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করানোও শিক্ষার উদ্দেশ্য।

বহির্বিশ্বের নিত্যনতুন জ্ঞান ও আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নিজ দেশের শিক্ষাসূচি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি পরিবর্তন করতে হবে প্রতিবছর। নিত্যনতুন জ্ঞান ও আবিষ্কারের খবরটা জানতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষকদেরই। তাঁরাই প্রস্তাব করবেন এই পরিবর্তনের। অতএব তাঁদের প্রতিনিয়ত পড়তে হবে নিজ নিজ বিষয়ের ওপর আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল। এই হালনাগাদ করার কাজটা যদি না করা হয়, আমাদের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায়।

পাঠক্রম কতটা মুখস্থনির্ভর হবে আর কতটা চিন্তানির্ভর হবে, তা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নামতা ও নতুন শব্দ মুখস্থ করার মতো কিছু বিষয় সব সময়ই থাকে, কিন্তু শিশু-কিশোরের চিন্তাশক্তিকে আঘাত করার বিষয় অনেক বেশি থাকতে হবে। না হলে তাদের কাছ থেকে নতুন জ্ঞান ও নতুন উদ্ভাবন আসবে না। বিজ্ঞানাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের মতো চর্চা বা অনুশীলন থেকে জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোতেও। সমাজই তাদের জন্য ল্যাবরেটরি। সমাজকে, মানুষের মনস্তত্ত্বকে মানুষের মাঝখানে থেকে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে হবে, তাতে ভালো নম্বর পেতে হবে কৃতকার্য হতে হলে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, মোট শিক্ষাবর্ষের একটা অংশ ছাত্রছাত্রীদের গ্রামে গিয়ে ইন্টার্নশিপ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যারা গ্রাম থেকেই এসেছে, তাদের জন্য দেশের অন্য কোনো প্রান্তে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কাছে থেকে দেখতে হবে সব ধরনের মানুষের জীবনযাপন, হাসি-কান্না। বুঝতে হবে কাদের শ্রমে চলছে এ জগৎসংসার। না হলে দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হবে না। যে শিক্ষাব্যবস্থা স্বার্থপর নাগরিক তৈরি করে, সে শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থার মূল সুর হতে হবে সমন্বিত জীবনচেতনা।

বাংলাদেশের একটি বিরাট দুর্বল দিক হলো শিক্ষা খাতে স্বল্প বরাদ্দ। ইউনেসকো–প্রস্তাবিত জিডিপির ৬ শতাংশের পরিবর্তে বাংলাদেশ বরাদ্দ করছে মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আবার ভালো দিক হলো চার দশক আগে যেখানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে কম শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারত, সেখানে আজ ৮০ শতাংশ। তার চেয়েও সুখবর হলো ছেলেশিশুর চেয়ে বেশিসংখ্যক মেয়েশিশু উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে, ভারতে ও পাকিস্তানে যে চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।

শিশুদের জন্য প্রদত্ত প্রণোদনার ফলেই হয়তো চার দশক আগের চেয়ে সংখ্যার এ বিরাট পরিবর্তন, কিন্তু আমাদের শিক্ষার মান এখনো খুব নিম্নই রয়ে গেছে আর তার কারণ মূলত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, শ্রেণির বিরাট আকৃতি ও ছাত্র–শিক্ষক অনুপাত। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত—শিক্ষার গুণগত মানের গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক প্রাথমিকে ২০১৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রটি এ রকম: মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যথাক্রমে ১০.১৬, ২০.৯১, ২২.৯৩, ৩০.০৫, ৩২.৭৫, ৩৪.৫৬, ৪৪.৭৮, ৪৭.৯৮। নিম্নমধ্য আয়ের ৭৫টি দেশের মধ্যে (২০১৭ যে উপাত্ত পাওয়া গেছে) বাংলাদেশের অবস্থানও নিচের দিকে (৬৭), যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের পাশাপাশি দুর্নীতিও শিক্ষার নিম্নমানের জন্য দায়ী। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পাওয়া, মফস্বলে বদলি হওয়া ঠেকানো, শহরের স্কুলে নিয়োগ নিয়ে ছাত্রদের কোচিং দিয়ে আয় বাড়ানো ইত্যাদি বড় কারণ।

শিক্ষকের বেতন যদি ভালো না হয়, মেধাবী অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল পাওয়া ছাত্ররা শিক্ষকতা পেশায় আসবে না। সে জন্য মেধাবীদের নিয়োগ করা, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই খাতে দুর্নীতি দূর করাও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষাব্যবস্থাই একটা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয়। উন্নয়নের অপরিহার্য যে শর্ত উন্নয়ন-আকাঙ্ক্ষা, তা সৃষ্টি হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুই শিশুর মনন গঠন করে। শিশু কী শিক্ষা পেল, তার ওপর নির্ভর করে সে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, আধুনিক, সংস্কৃতিমান, মুক্তচিন্তার ও সমন্বিত জীবনচেতনার অধিকারী হবে কি না। যদি না হয়, সে নিজের ও সমাজের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।

শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার মান, স্কুলিং ইত্যাদি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয়বৈষম্য দূরীকরণ, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ওপর যে কী গভীর ব্যাপক প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে অনেক বই, গবেষণাপত্র ও নিবন্ধ। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো মানে হিউম্যান ক্যাপিটাল, তথা মানবসম্পদে বিনিয়োগ করা। আমাদের যখন ফিজিক্যাল ক্যাপিটাল ও জমির পরিমাণ সীমিত, তখন প্রবৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র উপায় হলো মানবসম্পদে বিনিয়োগ করা।

ড. পিটার ওজিয়াম্বো ‘কোয়ালিটি অব এডুকেশন অ্যান্ড ইটস রোল ইন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উপসংহার টানেন এভাবে: জাতীয় উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হলো প্রধান উপাদান। তবে এ থেকে সুফল পেতে হলে শিক্ষার অর্থ ও কী তার উদ্দেশ্যে, তা পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষাকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। পর্যাপ্ত অর্থায়ন থাকতে হবে। শিক্ষা যদি প্রকৃতপক্ষেই শিক্ষা হয়, তাহলে তা হবে পেডাগজি অব হোপ, অর্থাৎ তা মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে, ক্ষমতায়নের স্বাদ দেবে। শুধু কিছু বাস্তব জ্ঞানের সঞ্চারণই নয়, শিক্ষক ছাত্রের সামনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, যাতে সৃষ্টির পরিবর্তে সে হয়ে উঠবে একজন স্রষ্টা। সমস্যা নয়, সে হবে সমস্যার সমাধান। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হবে বহুমাত্রিক, বহুবিধ, ব্যাপক ও গভীর, যাতে জ্ঞানতত্ত্বের সমস্ত দিকের পাশাপাশি থাকবে আদর্শ ও মূল্যবোধের দিকও।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]