আমার বেলা যে যায় না...

আমার বেলা যে যায়
আমার বেলা যে যায়

এবিএম মূসা ভাইয়ের নামের আদ্যক্ষর এ, পরের অক্ষর বি। আমার মুঠোফোনের এক নম্বর নামটা মূসা ভাইয়ের। কাজেই প্রায়ই তাঁর কাছে কল চলে যেত ভুলে, চাপ পড়ে। একটু পরে তিনি কল ব্যাক করতেন, ‘হ্যাঁ আনিস, বলো, ফোন করেছিলে কেন?’ আমি বলতাম, এই তো মূসা ভাই, আপনি কেমন আছেন, জানার জন্য। তিনি তখন নিজের কুশল, দেশের কুশল নিয়ে গল্প করতেন। নিজে থেকেও ফোন করতেন কখনো-সখনো, সাধারণত আমার লেখা গদ্যকার্টুন পড়ে। নিজে থেকে গোটা দুয়েক কৌতুক শোনাতেন। কখনো বা আমার লেখার আগেই ফোন করে বলতেন, ‘শোনো, এই কৌতুকটা তুমি তোমার পরের লেখায় ব্যবহার করবে।’ আমি বলতাম, জি আচ্ছা। লেখার সময় কৌতুকটা ভুলে গিয়ে আবার ফোন। মূসা ভাই, কৌতুকটা যেন কী ছিল?
তেমনি যন্ত্রণা করেছি যারা ভোর এনেছিল আর ভাষার ভোর নামের দুটো উপন্যাস লেখার সময়। মূসা ভাই তখন প্রায়ই প্রথম আলোয় আসতেন। বোধ হয়, তাঁর বই মুজিব ভাই বেরোচ্ছিল ‘প্রথমা প্রকাশন’ থেকে। প্রুফ দেখতে আসতেন। নিজের লেখা কলামের প্রুফ দেখতেও আসতেন আমাদের অফিসে। তিনি এলে ঘুরে ঘুরে আমার মতো জুনিয়র সাংবাদিকদের টেবিলে টেবিলে এসে খোঁজ নিতেন, কে কেমন আছে, জানতে চাইতেন। শিঙাড়া আর চা খেতে খেতে গল্পগুজব করতেন।
আমি জিজ্ঞেস করতাম, মূসা ভাই, ’৫০ সালে আপনি ঢাকা আসতেন কীভাবে? বঙ্গবন্ধু ’৪৭ সালে কোন বাড়িতে থাকতেন? নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যেতে হতো কীভাবে? মূসা ভাইয়ের কাছেই শুনেছি, কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসা কত কঠিন ছিল। প্রথমে যেতে হতো চাঁদপুর। সেখান থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকা। দেড়-দুই দিন লেগে যেত।
এবিএম মূসার লেখা আত্মজীবনীমূলক বই আমার বেলা যে যায় পড়তে গিয়ে সেসব কথা মনে পড়ছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটা মাত্র কদিন আগে বেরোল। সেই প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীও। কাইয়ুম চৌধুরীর সেদিনের ভাষণেও আমাদের সংবাদপত্রের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কিছু গল্প সেদিন শোনা হয়েছিল।
আমার বেলা যে যায় বইটা খানিকটা কতবেলের মতো। বাইরেরটা একটু শক্ত, কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পার হলেই? যতই ওপরে যাই নীল, যতই গভীরে যাই মধু। মূসা ভাইয়ের সেন্স অব হিউমার ছিল অসাধারণ। এই বইয়ে তাঁর সেই হাস্যরসের পরিচয় আছে পাতায় পাতায়। যেমন, তিনি লিখেছেন তাঁর বাল্যকালের শ্রেণিকক্ষের বর্ণনা: ‘এবার ছোট হুজুরের বাংলা পড়ানোর একটুখানি নমুনা দেব। তিনি বোঝাতেন, “ফুটিয়াছে সরোবরে কমল নিকর”, মানি বুইজসনি? কমলের অর্থ হইল গেয়া মানে পদ্মফুল। সরোবর হইল গেয়া ফইর, ফুষ্করণী, আঁরার ছইচ্যা। ফুটিয়াছে মানে ফুইট্টে, ফুইট্টে বুঝছস? ফুডি রইয়্যে, ভেটকাই রইয়্যে। তাইলে “ফুটিয়াছে সরোবরে কমল নিকর” মানে ফুষ্করণীর ভিতর পদ্মফুল ভেটকাই রইয়্যে।’ এই পর্যন্ত পড়ে আমি খিলখিল করে হেসে উঠি। হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসে।
চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের ছেলেরা স্কুলে আসত লুঙ্গি পরে। একবার তখনকার হেডমাস্টার আবদুর রহমান সাহেব নির্দেশ দিলেন, প্যান্ট পরে আসতে হবে। ছেলেরা স্কুলের গেট পর্যন্ত লুঙ্গি পরে এসে তারপর কাছা মারত, তার ওপরে প্যান্ট পরে ক্লাস সেরে বেরিয়েই আবার প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে বাড়ি ফিরত। সেই তিরিশ-চল্লিশের দশকের চট্টগ্রামের বর্ণনা থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল, ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালেই তাঁর যোগ দেওয়া, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারণায় অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে সাংবাদিকতার জীবন।
তিনি নিজে ছিলেন ক্রীড়া-উৎসাহী, পাকিস্তান আমলে পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বন্দ্ব যে ক্রীড়াজগতেও স্পষ্ট ছিল, তা নিয়েও তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তারও বিবরণ পাওয়া যাবে এই স্মৃতিলেখায়। একটা চমৎকার বর্ণনা আছে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর একটা সাক্ষাতের। সেই সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, কেন ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। এখন এটা অবশ্য আমরা একাধিক গ্রন্থ থেকে জানি যে ভারত অপেক্ষা করছিল শীত নেমে আসার জন্য, যাতে হিমালয় তুষারে ঢেকে অগম্য হয়ে পড়ে, চীন যেন ভারত আক্রমণ করে বসতে না পারে। ইন্দিরা গান্ধী সেদিন বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীন ছিল মিত্র, কেন চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল, সম্পর্ক কেন ভেঙে যায়, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। এবিএম মূসা লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী কতটা দূরদর্শী ছিলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তা বোঝা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল সম্পর্কে গভীর মমতামাখা নানা স্মৃতির বিবরণ আছে এই বইয়ে। আছে বঙ্গবন্ধুর হাস্যরসবোধের পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর নতুন মন্ত্রিসভা কেমন হয়েছে, কে কোন মন্ত্রণালয় পাচ্ছেন? বঙ্গবন্ধু আড্ডায় বলছেন, ‘উপযুক্ত ব্যক্তিকেই যথাযথ পদ দিয়েছি। তবে একটা দপ্তর নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
অনেক ভেবেচিন্তে সেটা জহুরের কাঁধে চাপালাম। দপ্তরটি হচ্ছে স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ। ভেবে দেখলাম, আমার মতো সারা জীবন জেল খাইটা তার শরীরডা খ্যাংরা কাঠির মতো হইয়া গেছে। সব ডাক্তারকে সে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো করার তাগিদ দিতে পারব। সে আবার দুই বউয়ের ১৪টি বাচ্চা নিয়া হিমশিম খাইতাছে। বেশি বাচ্চা হওয়ার জ্বালা সে-ই ভালো বুঝে। তাই তারে জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিছি।’ বঙ্গবন্ধুর হাস্যরসের আরও পরিচয় পাওয়া যায় এবিএম মূসার লেখা প্রথমার বই মুজিব ভাইয়েও।
এবিএম মূসা ১৯৭৩ সালে নির্বাচন করেছিলেন নোয়াখালী–১ আসন থেকে। বাকশাল গঠিত হওয়ার বর্ণনা তাই তাঁর আত্মজীবনীরই অংশ। তিনি লিখেছেন, ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হতে লেগেছিল ২৪ বছর, তিন মিনিটেই তার রূপটি এমনিভাবে বদলে গেল।’ এবিএম মূসার ধারণা, বাকশাল গঠনের বুদ্ধি বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন সোভিয়েতদের কাছ থেকে, ১৯৭৪ সালে চিকিৎসার জন্য মস্কো গিয়ে, সেখানে তানজানিয়ার রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারেও ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে তাঁর দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এবিএম মূসার এই ধারণা কতটা সত্য, তা অবশ্যই অনুসন্ধানের বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের সাংসদদের ডেকেছিলেন। শ খানেক সাংসদ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মোশতাকের মুখের ওপর প্রতিবাদ করেছিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক।
আমার বেলা যে যায় বইটি শেষ হয়েছে পারিবারিক প্রসঙ্গ দিয়ে। মূসা ভাই লিখেছেন, ৫৮ বছরের বিবাহিত জীবনে দুই খোকাখুকি এখন বুড়োবুড়ি। আমার মেজাজ ও রগচটা স্বভাবের পরিচয় যারা জানত, তারা জিজ্ঞেস করত, এই লোকটির সঙ্গে এত বছর কাটালেন কী করে? বুড়ির উত্তর, ‘কেট গেল, কেমন করে এত বছর একসঙ্গে রইলাম বুঝতেই পারি না।...’ সিসিইউতে যাওয়ার সময় হুইলচেয়ারে বসা সারা রাত অপেক্ষমাণ বউকে বললাম, ‘ওগো, চললাম।’ বুড়ি বলল, ‘ফাজলামো পেয়েছ, সারা জীবন এদিক-ওদিক একা ঘুরেছ। কোথায় কী আকাশকুসুম করেছ, খোঁজ নিইনি। এবার আমাকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না, যেতে পারবে না।’
সে যাত্রায় মূসা ভাই ফিরেছিলেন। আমিও সেবার তাঁকে দেখতে ল্যাবএইড হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তা-ও ওই মোবাইলে ফোনের ভুলেই। ফোন বাজছে, ধরে বলি, মুসা ভাই, কেমন আছেন। বললেন, ‘আমি তো ল্যাবএইডে।’ আমি বললাম, আসছি। দেখা করে এলাম।
কিন্তু পরের বার যখন ল্যাবএইডে গেলাম, তিনি সিসিইউতে, চোখ-মুখ কোটরে ঢুকে গেছে, যন্ত্র দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, গভীর ঘুমে। বুঝলাম, এবার আর বোধ হয় ফিরবেন না। ফেরেননি আর। তারপর তাঁকে দেখতে গেলাম ইকবাল রোডের বাসায়, তিনি তখন কাফনের কাপড়ে মোড়ানো।
আমার মুঠোফোনের এক নম্বর নম্বরটি এখনো মূসা ভাইয়ের। এই মোবাইলে কাইয়ুম চৌধুরীর নম্বর আছে, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর নম্বর আছে, সরদার ফজলুল করিমের নম্বর আছে, তারেক মাসুদের নম্বর পর্যন্ত ডিলিট করিনি।
এখন যদি মূসা ভাইয়ের নম্বরে কল যায়, তিনি কি বলবেন, আনিস, ফোন করেছ কেন, বলো? আমি কী বলব? মূসা ভাই, বড় অভিভাবকহীন লাগে, কথা বলতে ভয়ও পাই, ঢাকা যে মহিরুহশূন্য হয়ে যাচ্ছে, আমরা ছায়া পাব কোথায়?
তাঁরা থাকবেন না, তাঁদের কাজ আর আদর্শ আর সততা ও পেশাদারি নিষ্ঠার নিদর্শন থেকে যাবে। যেমন এখন আমার সামনে তাঁর বই, আমার বেলা যে যায়। মূসা ভাই, এই অবেলায় আপনাদের ছাড়া আমাদের বেলা কি যাবে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

আমার বেলা যে যায়  
এবিএম মূসা  প্রথমা প্রকাশন।
দাম: ৫০০ টাকা।