
বেঙ্গালুরুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যখন বাজছিল, মাশরাফি-সাকিব-তামিমরা ঠোঁট মেলাচ্ছিলেন, আমরাও বাংলাদেশের মানুষেরা যে যেখানে আছি, দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলাচ্ছিলাম। বিদেশের মাটিতে বাংলা কথা শুনলেই চোখ ছলছল করে, আর এটা তো আমাদের জাতীয় সংগীত। প্রতিটা দেশের মানুষের কাছেই নিশ্চয়ই তাদের জাতীয় সংগীত প্রিয়, আর আমাদের কাছে তা হয়তো একটু বেশিই প্রিয়। গত পরশু যখন টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজছিল, তখনো বেশ একটা আবেগ বোধ করছিলাম।
২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সময় ২০৫টা দেশের জাতীয় সংগীত বাজানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। ওই সময় সবগুলো জাতীয় সংগীত ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে আর বিশ্লেষণ করে ‘দ্য আর্ট ডেস্ক’ শীর্ষ তালিকা তৈরি করেছিল। ‘আর্ট ডেস্ক’ সংগীত ও শিল্পকলা–বিষয়ক প্রকাশনা, যাতে টেলিগ্রাফ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ইকোনমিস্ট-এর লেখকেরা যুক্ত। আর্ট ডেস্কের প্রতিষ্ঠাতা ইসমেন ব্রাউনের নিজের নামেই পৃথিবীর সেরা জাতীয় সংগীতগুলোর তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের মতে, সেরা ১০ স্বর্ণপদক জয়ী জাতীয় সংগীত হলো রাশিয়া, ইতালি, জাপান, বাংলাদেশ, জ্যামাইকা, ইসরায়েল, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ক্যামেরুন ও বুলগেরিয়া।
আর ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের সময় আরেকটা শীর্ষ তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। আলেক্স মার্শাল নামের একজন সাংবাদিক ও সংগীতজ্ঞ ২০৫টা জাতীয় সংগীত শুনে, বিশ্লেষণ করে উরুগুয়েরটাকে প্রথম আর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে দ্বিতীয় বলে ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে, বসেছিলাম বটগাছটার নিচে, বসন্তের কচি পাতা ঝকঝক করছে, দক্ষিণা বাতাস বইছে, অদূরে আমের গাছে মুকুলের সৌরভ। ফাগুনের তোর আমের বনে ঘ্রাণে, পাগল করে। সুনীল আকাশের নিচে বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আপন মনেই গেয়ে উঠলাম, কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। সত্যি, কী অপরূপ এই ছায়া। কী যে অনির্বচনীয় এই মায়া! এই বর্ধমান হাউসেই রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, এই আমগাছের দিকে তাকিয়েছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে এলে ঘরের ভেতরে বসতে চাইতেন না, বটগাছের নিচে বসতে পছন্দ করতেন।
আমাদের জাতীয় সংগীতটা কিন্তু বুক ভরে গাইবার মতোই একটা গান। রবীন্দ্রনাথের লেখা এই গানটার যে দিকটার প্রশংসা সবাই করে, তা হলো, এতে জাতিগৌরব ফুটে ওঠেনি, রাজা/রানির দীর্ঘজীবন কামনা করা হয়নি, এতে আছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কথা, আর আছে ভালোবাসার কথা। আমাদের জাতীয় সংগীতে আমরা রাজা/রানির প্রশংসা করি না, আমাদের সৈনিক দলকে এগিয়ে যেতে বলি না, আমরা বলি না যে আমাদের দেশ পৃথিবীর সেরা, আমরা বিনীতভাবে আমাদের দেশকে মা বলে ডাকি, আর বলি, মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বলি, চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি। এখানে জাতিগৌরব রয়, আত্মম্ভরিতা নয়, নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করা নয়, প্রকাশিত হয় কবিজনোচিত বেদনা, সৌন্দর্যবোধ। আর ভালোবাসা। মাকে ভালোবাসার কথা বলা, মায়ের মতন যে দেশ, তাকে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করা।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির একবার আমাকে বলেছিলেন, বিদেশের এক অনুষ্ঠানে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটা বাজছিল, এক বিদেশি শ্রোতা গানটির কথার মানে জানতে চাইলে শাহরিয়ার কবির সেটা অনুবাদ করে দিলেন। বিদেশি শ্রোতা বললেন, ‘গানটা তো শভিনিস্টিক (উৎকট স্বাদেশিকতায় দুষ্ট)!’
ধনধান্য পুষ্পভরা গানটায় নিজের দেশকে রানি বলার লাইনটা বাদে বাকি সব কথাই আমার খুবই পছন্দ। এমনকি ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ কথাটাও। এতে ভালোবাসার কথা আছে, বড়াই নেই, আর আমার মা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, এটা আমরা সবাই মনে করি, এটা ভালোবাসা নামক অনুভূতির নির্দোষ প্রকাশ মাত্র। আর ওই যে কথাটা, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা—আমাদের খুবই উদ্বুদ্ধ করে। আসলেই আমরা স্বপ্ন আর স্মৃতি দিয়েই দেশটা তৈরি করেছি। দেশটা সত্যি সত্যি তলাবিহীন ঝুড়ি ছিল। আমাদের শৈশবে আমরা দেখেছি সেই ভীষণ দারিদ্র্য, অভাব। আমাদের সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে তার নমুনা ধরা আছে—পথের পাঁচালী ছবিতে, সূর্য দীঘল বাড়ীতে, ছেঁড়া তার নাটকে, জয়নুলের দুর্ভিক্ষ ছবিতে। সেখান থেকে একটা দেশ যে উঠে এল, তা কেবল স্বপ্ন আর স্মৃতিকে সম্বল করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আমার সোনার বাংলা গানটি পূর্ববঙ্গে বসে লিখেছিলেন। সুরটা তিনি নেন শিলাইদহের বাউলশিল্পী, যিনি ডাকঘরের হরকরার কাজ করতেন, সেই গগন হরকরার গান ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ থেকে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই গানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার আলো-বাতাস আর মাটি মিশে আছে।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের সারা দেশের প্রতিনিধিদের দুই দিনব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সভার শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধনধান্য পুষ্প ভরা আর আমার সোনার বাংলা গান দুটি পরিবেশিত হয়। সেই রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে ওয়াজেদ মিয়াদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশটা যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটাকে গ্রহণ করো।’ আমার সোনার বাংলা গানটা অবশ্য ১৯৫০-এর দশক থেকে পূর্ব বাংলার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছিল। জহির রায়হান তাঁর আরেক ফাল্গুন উপন্যাসে দেখিয়েছেন, ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে যারা গ্রেপ্তার বরণ করেছিল, কারাগারে তারা সমবেত কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইছে। জহির রায়হানের অমর ছবি জীবন থেকে নেয়াতেও আমরা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র ব্যবহার দেখি। সন্জীদা খাতুনের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়, ১৯৫৬ সালে কার্জন হলে গণপরিষদ সদস্যদের সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। তারেক মাসুদের মুক্তির গানে আমরা দেখি, মুক্তিযোদ্ধারা ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইছেন।
এই গানটা মন দিয়ে গাইতে গেলে চোখের কোণে আপনাআপনি অশ্রু চিকচিক করে। সেবাসটিয়ান কো, লন্ডন অলিম্পিক ২০১২-এর সভাপতি, দৌড়ে যিনি নিজে জিতেছেন একাধিক সোনা, বিজয়স্তম্ভে উঠে জাতীয় সংগীত শোনার অনুভূতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যেকোনো খেলাতেই জাতীয় সংগীত বাজার মুহূর্তটি সবচেয়ে আবেগপূর্ণ অংশ, আর আমার কাছে মস্কো আর লস অ্যাঞ্জেলেসে তা ছিল সবচেয়ে অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।’ লন্ডনের আর্ট ডেস্ক অবশ্য ব্রিটিশ জাতীয় সংগীতকে রেখেছে খারাপের তালিকায়।
আমাদের হৃদয়ে জাতীয় সংগীত এক অপূর্ব রসায়ন তৈরি করে। আমরা এই সংগীত অর্জন করেছি যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে। আর যে দেশ মোটেও স্বাধীনতার জন্য অর্থনৈতিকভাবে উপযুক্ত নয়, সেই দেশকে স্বাধীন করে আমরা কেবল টিকে আছি, তাই নয়, আমরা ভালোও করছি। কাজেই আমাদের মাবিয়া আক্তার সীমান্ত নামের মেয়েটি যে গুয়াহাটি এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা জয় করে বিজয়স্তম্ভে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের মূর্ছনায় অভিভূত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়বেন, এটা খুবই স্বাভাবিক।
আমাদের জাতীয় সংগীতের উৎকর্ষ নিশ্চয়ই আমাদের গৌরবান্বিত করবে। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে পারা ভালো যে লোকে আমাদের জাতীয় সংগীতকে ভালো বলে এর সৌন্দর্যের জন্য, এর কাব্যময়তার জন্য, এর অকৃত্রিম ভালোবাসাবোধের জন্য, এটা শভিনিস্টিক নয় বলে। আমার দেশ আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর সব মানুষ সমান, কেউ কারও চেয়ে বড় বা ছোট নয়। তেমনি পৃথিবীর সব স্বাধীন দেশের মর্যাদাও সমান। আমাদের জাতি গর্বে অন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত নয়। তেমনি জাতিবৈরীও হওয়া উচিত নয়। একটা জেলায় যেমন ভালো মানুষ থাকে, খারাপ মানুষ থাকে, ভালো মানুষও সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয় না, খারাপ মানুষও সব সময় খারাপ থাকে না, তারও অনেক ভালো গুণ থাকে। নিজের দেশ, নিজের মত, নিজের গোষ্ঠী, নিজের বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠ এবং সর্বমান্য জ্ঞান করার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর সব হানাহানির সূচনা। হিটলার, মুসোলিনি বিশ্বযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে। এটাকেই বলে ফ্যাসিবাদ।
আমরা যেন এই বিষয়টা মনে রাখি। বিনয়, পারস্পরিক সম্মানবোধ, অন্যকে শ্রদ্ধা, বৈচিত্র্যকে মান্য করা, অন্য রকমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা—এগুলো একেবারে প্রাথমিক গুণ—যা আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসতে গিয়ে অন্যের দেশকে হেয় করতে হয় না, এই কথাটা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই।
বাংলাদেশের একটা ভালো দিক আবার বাংলাদেশের একটা দুর্বল দিক। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় একই রকম দেখতে, আর বেশির ভাগই একই ভাষায় কথা বলি। এটা না হলেই বোধ হয় ভালো ছিল। আমাদের সব ভাষা, সব নৃগোষ্ঠীকে সমান সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিতে পারতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশের রাজধানীতে আপনি দেখবেন সারা পৃথিবীর নানা রকম চেহারার মানুষ, এটা এই দেশে দেখা যায় না। এটাও ভালো কথা নয়।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের জাতীয় সংগীতটা সুন্দর। শভিনিস্টিক বা উৎকট স্বাদেশিকতায় দুষ্ট নয়। আমাদের মনের মধ্যেও যেন উৎকট স্বাদেশিকতা স্থান না পায়। সেটা ক্রিকেটের মাঠেই হোক, আর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে হোক। তবে ওই কথাটার মানে আমাদের চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে না—মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো। মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি। বাংলা মায়ের মুখ মলিন হলে আমরা নয়ন জলে ভাসতে থাকি। তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করে থাকি। নিজেদের উৎকট স্বাদেশিক কিংবা অশোভন আচরণ যেন আমার মায়ের মুখকে মলিন করে না দেয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।