আমিনবাজারের গণপিটুনিতে মৃতরা যদি সত্যিই ডাকাত হতো?

লিখতে বসে হুমায়ূন আহমেদের নিমফুল নাটকটির কথা মনে পড়ল। এক ডাকাতের চোখ তোলার গল্প। ডাকাতের চোখ তোলা হবে—এ খবরে গ্রামের সবার সেকি আনন্দ! উৎসবে যেমন ভালো খাবার রান্না হয়, তেমনি ডাকাতের চোখ তোলা উপলক্ষে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ ‘তামাশা দেখতে আসা’ মানুষের জন্য বিশাল ভোজের আয়োজন। নাটকটি আমাদের জীবনে বহুবার শোনা সত্য ঘটনারই নাট্যরূপ।

১০ বছর আগে রাজধানীর অদূরে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে একটি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী ভীষণ আলোড়ন তোলে। পবিত্র শবে বরাতের রাতে সাত বন্ধু ঘুরতে গিয়েছিলেন আমিনবাজারের সেই গ্রামে। রাত সোয়া একটার দিকে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত তাঁদের ডাকাত বলে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। এতে ছয়জন মারা যান, একজন প্রাণে বাঁচেন। দীর্ঘ ১০ বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২ ডিসেম্বর সেই মামলায় ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর খালাস দেওয়া হয় ২৫ জনকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো গণপিটুনিতে হত্যার রায় হলো। তাই একজন নাগরিক হিসেবে রায়টি স্বস্তিদায়ক হতেই পারত, কিন্তু হলো না।

আমিনবাজারের মতো একই ধরনের ঘটনার বিচার চলছে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম (রেনু) হত্যাকাণ্ডের। ছেলে ধরা সন্দেহে একদল লোক স্রেফ পিটিয়ে মারে তাঁকে। বিষণ্নতাসহ আরও কিছু মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত তাসলিমাকে যখন মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছিল, তখন মৃত্যুর আগে তিনি বারবার বলছিলেন ‘আমি ছেলেধরা না’।

গণপিটুনি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। নিমফুল নাটকটির মতোই আয়োজন করে, উৎসবের আমেজ নিয়ে গণপিটুনিতে অংশ নিই আমরা। স্যান্ডেল চোর থেকে শুরু করে ডাকাত, ছেলেধরা, ছিনতাইকারী কেউ একজন হলেই হলো। অথচ দেশে আইন আছে, আদালতও আছে, আছে পুলিশ-প্রশাসন। চোর-ছিনতাইকারী গণপিটুনিতে মারা গেলে আজ পর্যন্ত বিচার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বিচারের আগেই আমরা সাব্যস্ত করি কে অপরাধী আর কে নয়। ‘কথিত অপরাধী’ মানুষ পেলে বিচারটা আমরা নিজের হাতে তুলে নিই, রায়ও ঘোষণা করি আমরাই। এমনকি সেই রায় কার্যকরও করি নিজের হাতে। শুনতে যত অদ্ভুতই লাগুক না কেন, ঘটনাটি আসলে তাই ঘটে।

পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনা প্রতিবছর ঘটে অনেক। অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে মামলাই হয় না। কখনো কখনো দায়সারা গোছের মামলা হলেও সেই মামলা শেষ হয়ে বিচার হতে আমরা দেখি না। বিচার হচ্ছে না কেন, সে প্রশ্ন আমরা নাগরিকেরা করি না। জানি, এই দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আছে। কিন্তু বিচার না হলেও এসব মৃত্যুতে আমাদের আদৌ কি কিছু যায়-আসে? আমাদের মনের কোথাও কি একটুও দুঃখবোধ থাকে মুহূর্তের জন্যও? আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘চোরের মতো পিটিয়ে মারা’। এই কথাটিই আমাদের মনস্তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়। চোরকে ইচ্ছেমতো পেটানো যায়, পিটিয়ে মারা যায়, সেটি নিয়ে দ্বিধা করার কিছু নেই, অপরাধবোধ তো অনেক পরের ব্যাপার।

আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমিনবাজারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সেই সময়ে আমাদের মধ্যে ভীষণ তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। ঘটনায় একসঙ্গে মারা যান ছয় তরুণ, এটাই কি কারণ ছিল আমাদের দারুণ সংবেদনশীলতার? আমি গুগল করে দেখলাম, দেশে বিভিন্ন সময়ে চার-পাঁচ-ছয়জন মানুষকে ডাকাতি বা অন্য অভিযোগে বা সন্দেহে একসঙ্গে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সেসব সংবাদও পত্রিকায় এসেছে, কিন্তু সেই সংখ্যা তো আমাদের সংবেদনশীল করে তোলেনি।

আমিনবাজারে ঘটা ঘটনাটির পরপরই সংবাদমাধ্যমগুলো রিপোর্ট করে আমাদের জানায় নিহত ছয় তরুণ ডাকাত ছিলেন না; শবে বরাতের রাতে তাঁরা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। হ্যাঁ, আমাদের সংবেদনশীলতার কারণ আসলে এটাই। ‘ডাকাত নয়’ এমন মানুষকে ডাকাত অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে মানুষ, সেটা মেনে নেওয়ার মতো ‘অসংবেদনশীল’ নই আমরা।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল লিমনের কথা। ওই যে র‍্যাবের গুলিতে পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া লিমন। আমরা, নাগরিকেরা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম। শুধু কি আমরা? জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান লিমনকে নিয়ে অনেক ‘পপুলিস্ট’ আচরণ করেছিলেন। তাঁর শয্যাপাশে গিয়ে কাঁদা থেকে শুরু করে তার বিচার নিশ্চিতের চেষ্টা করা পর্যন্ত। একদিক থেকে দেখতে গেলে লিমন তো ‘ভাগ্যবান’, সে প্রাণে বেঁচে গেছে। কিন্তু এই দেশে এখন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে যে চার হাজারের বেশি মানুষ, যারা প্রায় সবাই অনেক গুরুতর অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের জন্য আমাদের কি আদৌ সহানুভূতি আছে? মানবাধিকার কমিশনের লোকজন কি কখনো এমন কারও বাড়ি গিয়ে অন্তত তাদের সহানুভূতি জানিয়েছিলেন তাদের ওপরে অবিচারের জন্য?

লিমনের ঘটনা আমাদের সংবেদনশীল করে তুলেছিল কারণ লিমনও ‘অপরাধী’ ছিল না। একই কারণে ‘আব্বু কান্না করছ যে’ অডিও খ্যাত একরামুলের বিচারবহির্ভূত হত্যা আমাদের ভেতরটা তোলপাড় করে তুলেছিল। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধেও ভয়ংকর অপরাধের কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি।

আমরা যারা লিমনের পা হারানো বা একরামুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে কষ্ট পেয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি তারাই কিন্তু ‘ডাকাত শহীদ’-এর মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের মৃত্যুতে উৎসব করেছি, মিষ্টি বিতরণ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে নিয়ে গিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ করে ফিরে যাচ্ছে আর রাস্তায় অনেক মানুষ তাদের গাড়ির পাশে করতালি দিয়ে তাদের অভিনন্দিত করছে এমন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল কিছুদিন আগেই।

আমাদের মনস্তত্ত্ব হলো আমাদের দেশে অপরাধের বিচার যেহেতু হয় না, শাস্তি তো অনেক পরের ব্যাপার, তাই নিজের হাতে যত দূর সম্ভব বিচার নিশ্চিত করা। সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মদদে চলা ক্রসফায়ার আমাদের ভাবতে শেখায় একজন কথিত অপরাধীর বিচার পাওয়ার কিছু নেই, তাকে চাইলে বিনা বিচারে হত্যা পর্যন্ত করা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মেজর সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ডেও আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়লাম। কারণ একই, একজন নিরপরাধ মানুষকে এভাবে খুন করে ফেলা। অথচ এ ঘটনার আগেই মূল অভিযুক্ত ওসি প্রদীপের একটা ভিডিও পাওয়া যেত, যেখানে এক সভায় তিনি প্রকাশ্যে মানুষকে বিনা বিচারে হত্যার কথা শুধু যে স্বীকারই করছেন তা না, গর্ব করছেন সেটার জন্য। তিনি জানেন আমাদের মনস্তত্ত্ব, তাই সেই ভিডিওতে দেখা যায় তিনি কোনো নিরপরাধ মানুষকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন কি না, সেটা উপস্থিতদের কাছে জানতে চান। সিনহা রাশেদ হত্যায় ফেঁসে যাওয়ার পর সেই ভিডিও অনেকেই দেখেছি আমরা, কিন্তু খুব আলোচনা তো আমরা করিনি। কারণ, আমাদের ধারণা বা বিশ্বাস তার অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর শিকার ছিল সম্ভবত সত্যিকার ইয়াবা কারবারি অপরাধীরা।

শিরোনামে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মাত্রই যে গণপিটুনিতে হত্যার বিচার শেষ হলো, সেই হত্যার শিকার ব্যক্তিরা যদি নিরপরাধ তরুণ না হয়ে ভয়ংকর ডাকাত হতো, তাহলে কী হতো? তাদের হয়ে কি বিচার চাইতাম আমরা? নাকি এই দেশ থেকে ছয়জন ডাকাতকে নির্মূল করে দিতে পারার আনন্দ কিংবা স্বস্তিতে বিভোর থাকতাম?

বাড্ডায় পিটিয়ে মেরে ফেললাম যে তাসলিমাকে, সেই তাসলিমাও যদি সত্যিকার ছেলেধরা হতো, তাহলে কি আমরা দুঃখ পেতাম? মানুষের বেদম মার খাওয়া বিধ্বস্ত তাসলিমার মৃত্যুর এক ছবি আমাদের সামনে এসে একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয় আমাদেরও। তাসলিমা সত্যিই ভয়ংকর এক ছেলেধরা চক্রের সদস্য, এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে সেই মর্মান্তিক ছবিটি কি আমাদের ভেতরটা বিদীর্ণ করে দিত এভাবে? তাসলিমা যে বাঁচার জন্য বারবার বলছিলেন, ‘আমি ছেলেধরা না’, সেটাই কি পিটিয়ে কাকে মেরে ফেলা যাবে আর কাকে যাবে না, সেটা নিয়ে আমাদের মনস্তত্ত্বের এক দারুণ প্রমাণ না?

আমি জানি, ন্যূনতম সভ্য দেশের মতো এই দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচার হয়ে যায় না। বিচার চাইতে হয়। চাঞ্চল্যকর মামলা হলে বিচার পাওয়ার কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়, কিন্তু আবার তার সঙ্গে যদি শক্তিমান কেউ জড়িত থাকে, তাহলেও সেটার বিচার হয় না। জানি, অনেক অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও তারা অনেক সময় বেরিয়ে আসে তদন্তের গাফিলতি, দুর্নীতিসহ নানা কারণে। তাই নিজ হাতে কাজ শেষ করে ফেলাকেই আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।

আমি এটাও জানি, আমাদের দেশের মানুষ জীবনযাপন করে নানা অবদমনের মধ্য দিয়ে। চরম অবদমিত মানুষ কোথাও না কোথাও তার অবচেতনের ক্ষোভ-রাগ উগরে দিতে চাইবেই। উৎসব করে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার এটাও হতে পারে একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। এ দুটো বিষয়েই আমাদের কাজ করতে হবে মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে। কিন্তু এগুলো কোনোটাই যুক্তি হতে পারে না এ বর্বরতার।

আমরা এটা খেয়াল করি না, আমরা যখন বিশ্বাস করি অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে ফেলা গেলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার আছে আমাদের, তখন সেই বয়ান রাষ্ট্রকেও একই কাজ করতে প্ররোচিত করে। বিনা বিচারে মানুষ খুন করতে করতে এখন আর রাখঢাকও নেই। সংসদের ভেতরে সাংসদেরা, সংসদের বাইরে সরকারের প্রতিমন্ত্রী কেউ ক্রসফায়ারযোগ্য অপরাধ হিসেবে নতুন অপরাধকে যুক্ত করার দাবি জানান আবার কেউ ক্রসফায়ার সমর্থন করে বক্তব্য দেন। এগুলো পরিষ্কার জনতুষ্টিবাদী বক্তব্য, কিন্তু তাঁরা এটা করেন এবং পারেন, কারণ তাঁরা জানেন আমাদের মনস্তত্ত্ব।

আমাদের মনস্তত্ত্ব হলো আমাদের দেশে অপরাধের বিচার যেহেতু হয় না, শাস্তি তো অনেক পরের ব্যাপার, তাই নিজের হাতে যত দূর সম্ভব বিচার নিশ্চিত করা। সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মদদে চলা ক্রসফায়ার আমাদের ভাবতে শেখায় একজন কথিত অপরাধীর বিচার পাওয়ার কিছু নেই, তাকে চাইলে বিনা বিচারে হত্যা পর্যন্ত করা যায়। অথচ আইন বলে ১০ জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবু যেন একজন নিরপরাধ শাস্তি না পায়। সেখানে এখন মানুষ সে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী যা-ই হোক না কেন বিনা বিচারে তাকে হত্যা করা, সেটা গণপিটুনি হোক কিংবা ক্রসফায়ার, কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। এ দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে দুর্নীতি, আছে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতার অভিযোগ। কিন্তু এর কোনোটিই যুক্তি হতে পারে না। বিনা বিচারে কাউকে হয় গুলি করে, না হয় স্রেফ পিটিয়ে মারার, হোক না সে দুর্ধর্ষ অপরাধী।

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী