
আম হলো ফলের রাজা। আম নিয়ে রয়েছে বহু ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। ছোটবেলায় আমাদের লেখাপড়া শুরু হয় ‘আম পাতা জোড়া জোড়া, মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া’-এসব কবিতা দিয়ে। আবার আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে মেহেরপুরের আম্রকানন, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। আম খেতে পছন্দ করে না, এমন লোকের সংখ্যাও খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে কয়েক বছর ধরে আম খাওয়া নিয়ে চলছে নানান কাণ্ড। আমের ভালো গুণাগুণের সঙ্গে যোগ হয়েছে অপপ্রচারও। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। নানান অপপ্রচারের কারণে দেশের চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আতঙ্কে কিনে আম খাওয়া ছেড়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যাও এখন অনেক বেশি। আর এতে অপুষ্টিজনিত নানান রোগ-বালাইয়ের সমস্যা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি দেশীয় এ ফলের বাজার চলে যাচ্ছে মাফিয়া ডনদের হাতে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভেজালবিরোধী নানান অভিযানের ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। যারা এখনো ভেজাল পণ্য বিক্রি ও বাজারজাত করার চেষ্টা করছে, নিয়মিত অভিযানে এসব অসাধু চক্রকে জেল-জরিমানা করার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে ইথোফেন ও কারবাইড দিয়ে ফল পাকানোর ব্যাপারটি একটু ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে মনে হয় অপপ্রচারই বেশি হচ্ছে।
বছর কয়েক আগেও ফল খাওয়া নিয়ে মানুষের এত নেতিবাচক ধারণা ছিল না। গ্রাম ও শহরের মানুষ সবাই মিলে দেশীয় ফল, বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে আম-কাঁঠালের স্বাদ নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত। অর্থবিত্তশালী আমপাগল অনেক মানুষ বিদেশ থেকে দেশে আসত শুধু আমের স্বাদ গ্রহণের জন্য। তৃপ্তি ভরে নিজে খেত আর পাড়াপড়শি ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলাত। জুন-জুলাই মাস এলে আমের রস দিয়ে নতুন ধানের তৈরি চিড়া-মুড়িকে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে তৃপ্তি করে খেত গ্রামবাংলার মানুষ। পাকা আমের মধুর রসের গন্ধে চারদিক ম-ম করত। কোথাও কোথাও আবার একে ঘিরে শুরু হতো নানান উৎসব। কিন্তু আমে রাসায়নিক তথা কীটনাশকের নানান ব্যবহার নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রচারের কারণে আম খাওয়ার উৎসাহে এখন কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে।
কিছুদিন আগে ঢাকার কারওয়ান বাজার এবং যাত্রাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ধ্বংস করা হয় কয়েক হাজার মণ আম। মিডিয়ায় দেখলাম, তাঁদের অভিযোগ-আমগুলো ছিল অপরিপক্ব এবং ইথোফেন ও কারবাইড দিয়ে পাকানো। ঠিক একইভাবে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঢাকার গাবতলীতে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে কয়েক শ টন আম ও অন্যান্য ফল ধ্বংস করা হয়েছিল এবং দেখা গিয়েছিল, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হয়েছিল, তা বাতাসে ফরমালডিহাইড মাপার যন্ত্র। পরবর্তী সময়ে তিনটি সংস্থার পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সেই যন্ত্রটিকে অকার্যকর বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু এর আগেই যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে গেছে। যেখানে আমাদের দেশের এখনো এক-তৃতীয়াংশ লোক অপুষ্টিতে ভোগে, সেখানে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কয়েক হাজার মণ আম ধ্বংস করা কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে আমাদের আরও বেশি ভাবতে হবে।
কারবাইড ও ইথোফেন হলো বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ফল পাকানোর রাসায়নিক, নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল পাকানোর রাসায়নিক হিসেবেই তা সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কারবাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কারবাইড তাপ উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে কারবাইড নিষিদ্ধের কারণ হলো, কমার্শিয়াল কারবাইডে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক ও ফসফিন অপদ্রব্য হিসেবে মিশ্রিত থাকে, যা প্রয়োগকারী বা ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা কম সময়ের মধ্যেই (২৪ ঘণ্টা) নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। মজার ব্যাপার হলো, ইথোফেন ও কার্বাইডকে তাৎক্ষণিকভাবে মাপার জন্য কোনো যন্ত্র আমাদের দেশে নেই। আর ইথোফেন কিংবা কারবাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদে কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। তাহলে কোন ক্ষতির প্রভাবের কারণে আমাদের সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় আমগুলোকে ধ্বংস করলেন, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আর ফরমালিন ফল ও শাকসবজিতে কাজ করে না। এটা শুধু আমিষে কাজ করে। ফরমালিনমুক্ত আমের যেসব ব্যানার দেখা যায়, তা অত্যন্ত হাস্যকর। আমে প্রাকৃতিকভাবেই ফরমালিন থাকে। আম পাকানোর জন্য ফরমালিন কোনোভাবেই দায়ী নয়। অধিকাংশ সময় আমরা ভ্রান্ত ধারণা থেকে বলি যে বাজারের সব আমই ফরমালিনমিশ্রিত। আমাদের এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে কোনো ফল ক্ষতিকর কি না, তা বলা যাবে না।
অপরিপক্ব আম বাজারে আসুক এবং ভোক্তারা অধিক দামে কিনে খাক, সেটা আমাদের ভাষ্য নয়। আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই, ঠুনকো অজুহাতে যেন হাজার হাজার টন ফল আর ধ্বংস করা না হয়। কোনো বিষয়কে পরিপূর্ণ ধ্বংস করার আগে যেন এর ক্ষতিকর ও উপকারের মাত্রা হিসাব-নিকাশ করে ধ্বংস করা হয়। মনে রাখতে হবে, সামান্য পরিমাণে যদি রাসায়নিক থেকেও থাকে, এর কারণে আমে যে উচ্চমানের ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান আছে, তা নষ্ট হয় না। আর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, প্রতিদিন আমাদের ফল ও সবজি খাওয়া দরকার ৪০০ গ্রাম, সেখানে আমরা খাই মাত্র ২৪৮ গ্রাম। যেখানে আমরা এমনিতেই কম পরিমাণে খাই, সেখানে রাসায়নিকের ভয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিলে এর ঘাটতি কি অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব?
এসব বিষয়ে আমাদের ভোক্তা সাধারণসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমরা যদি পরিপূর্ণ স্বাদ ও পুষ্টি উপাদান পেতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের আম পরিপক্বের নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই সবশেষে বলতে চাই, দেশীয় ফল আম নিয়ে কোনো অপপ্রচারের আগে যাচাই-বাছাই করে দেখুন, খারাপ অথবা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু না পেলে অবশ্যই অপপ্রচার থেকে বিরত থাকুন।
লেখকবৃন্দ কৃষিবিজ্ঞানী ও শিক্ষক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
mticsau@yahoo. com