আশ্রয়ণ প্রকল্প: ভালো উদ্যোগ, ভুল কল্পনা

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ভেঙে পড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর

সর্বত্র আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভাঙা ঘরের ছবি। কেউ হুংকার ছাড়ছেন নিজেদের দিকে না তাকিয়েই। কেউ কলাম লিখছেন ‘দায় কার?’, ‘এত স্পর্ধা কেন?’ ইত্যাদি শিরোনামে। গণধারণা হচ্ছে আমি ভালো আর সব চোর। আমলারা খোসা, আম, আঁটি—সব চিবিয়ে হাপিশ করে দিতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত সাকল্যে কমবেশি ৩০০টি ত্রুটিপূর্ণ বাড়ি নির্মাণের কথা উঠেছে, যা মোট বিতরণকৃত সংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। তবে শতাংশের হিসাব দিয়ে কোনো অবহেলা বা গাফিলতিকে ছোট করে দেখার জন্য এ লেখা নয়।

ইতিমধ্যে অনিয়মের অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ সদর ও বরগুনার আমতলীর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও); বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) এবং মুন্সিগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ওএসডি করা হয়েছে। তাঁদের একজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ আরও কিছু কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।

বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ, এটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। অনিয়মের তদন্তে জুলাই মাসে করোনা মহামারির মধ্যেই মাঠে ছুটে গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঁচটি দল। আশা করা যায়, তারা কল্পনা আর বাস্তবতার ফারাকটা অনুধাবন করতে পারবে আর অভিযোগের কারণ-অকারণগুলোও খুঁজে পাবে।

আশ্রয়ণ-২ কী

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার খাতিরেই হোক আর ঠিকাদারদের তেলেসমাতির কালো ছোঁয়া থেকে দূরে রাখার জন্যই হোক, ইউএনওকে এ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেখভালে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বলা হয়, খাসজমিতে তৈরি হবে ঘরগুলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে কাজ। দৃষ্টিনন্দন রঙিন টিনের দুই কামরার সেমিপাকা বাড়ি হবে। ঘরের আয়তন হবে দৈর্ঘ্যে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি আর প্রস্থে ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। রান্নাঘর ও শৌচাগার থাকবে। প্রতি ১০ ঘরের জন্য একটি নলকূপ। সব মিলিয়ে বাড়িপ্রতি খরচ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ইটের সংখ্যা, সিমেন্ট ও বালুর পরিমাণও বলে দেওয়া হয় নকশা মোতাবেক। নির্দেশিকা অনুসারে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

ইউএনও ছাড়া এই বাস্তবায়ন কমিটিতে আছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে ২ শতাংশ জমির ওপর দুই কামরার বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

পেছনের কথা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রথমে দুর্যোগসহনীয় বাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। লক্ষ্য ছিল, প্রতিটি গ্রামের একজন করে মোট ৬৮ হাজার ৩৮টি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় এক বৈঠকে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে। ঠিক হয়, দেশের সব গৃহহীন ও ভূমিহীন (৬ লাখ ৮ হাজার ৫১৪টি) পরিবারকে সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এরপর ঘর নির্মাণে নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি নকশা, এস্টিমেট ও ডিজাইন তৈরি করে।

বাড়িপ্রতি বরাদ্দ টাকা কি যথেষ্ট

যথেষ্ট ছিল না বলেই তিন দফায় খরচ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্ধারিত ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে এসে হয়েছে দুই লাখ টাকা। অন্যদিকে খাসজমি চিরকালই কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। মামলা আর দখলমুক্ত খাসজমি হয় খুবই নিচু, জনবসতি থেকে অনেক দূরে বা চর এলাকায়। সেখানে ভূমি উন্নয়নে পাইলিং, মাটি ভরাটসহ নানাবিধ কাজ করতে হয়। সে টাকা কোথায় পাবেন ইউএনও? এক ইউএনও এসব বাস্তবতা নিয়ে দরবার করতে গিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসক বিরক্ত হয়ে সাফ জানিয়ে দেন, ‘না পারলে বাড়ি চলে যান।’ মুখের ভাষার সঙ্গে যে শারীরিক ভাষা প্রয়োগ করে তিনি তাঁর তরুণ সহকর্মীকে কথাগুলো শোনালেন, তা বর্ণনাযোগ্য নয়। তাঁর মেসেজ ছিল, ম্যানেজ করো যেভাবে পারো।

ম্যানেজ করা কাকে বলে, তা জানেন পিআইও। তাঁদের কাছে সবই সম্ভব। বকা খাওয়া ইউএনওকে তিনি আশ্বাস দেন, ‘হয়ে যাবে স্যার, আমি তো আছি।’ পিআইও আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব। ঘাটতি পূরণের জন্য তাঁরা নানা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে সহযোগিতা নিয়েছেন। কোথাও উপযুক্ত খাসজমি না পেয়ে তড়িঘড়ি করে খালের কিনারায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আর খরচ বাঁচাতে লাগোয়া খালের মাটি কেটেই বাড়ির চারপাশে দেওয়া হয়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই আলগা মাটি খালে চলে যাওয়ায় ঘরগুলো ভেঙে পড়ছে। কোথাও ১০ ইঞ্চির বদলে ৬ ইঞ্চি ফাউন্ডেশনে ঘর উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ঘর হস্তান্তরের দুই মাসের মাথায় ঘরের দরজা-জানালা খুলে গেছে। কোথাও ভেঙে পড়েছে। খরচ বাঁচাতে বালু-সিমেন্টের অনুপাতে আপস করতে হয়েছে। ফলে ঘরের পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে।

সম্প্রতি গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মাঠের এ বাস্তবতা বুঝে বলেছেন, ‘সারা বাংলাদেশে দেখছি ছবি আপলোড হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় ঘর ভেঙে গেছে। গোপালগঞ্জ নিচু জায়গা। এখানে মাটিরও স্বল্পতা আছে, বালু ফেলতে হয়। কোথাও পানি জমে থাকলে পানি বের হওয়ার সময় তখন বালুটাও সরে যায়। কোথাও কোনো ত্রুটি থাকলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঠিক করে দেব।’

বাস্তবতা আর যাঁদের জন্য এত আয়োজন, সেই গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আমরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করব, ততই মঙ্গল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে নিজেদের তাড়াহুড়ার ভুল ঢাকতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলির পাঁঠা বানানোর ফল কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]