আসছে আরেকটি মহামারি, বাড়ছে কর্তৃত্ববাদী শাসন, কেমন যাবে ২০২২?

এক বছর যাবৎ ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য মানুষের অপেক্ষার পর, এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কোভিড-১৯ তা সম্ভব হতে দেবে না। মহামারি তৃতীয় বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও আন্তর্জাতিক আদান-প্রদান মহামারির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২২ সালের জন্য এই মহামারি চারটি কঠিন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এর সবগুলি মোকাবিলা করতে হলে আস্থা সৃষ্টি করা খুবই জরুরি।

কাজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বদল হলো প্রথম চ্যালেঞ্জ। কিছু কিছু দেশে লকডাউন, প্রিয়জনদের মৃত্যু এবং মহামারিজনিত সার্বিক অনিশ্চয়তা আমাদের নতুন করে চিন্তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে যে পরিমাণ কর্মী কাজ ছেড়েছেন তার সংখ্যা চল্লিশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অনেক চীনা তরুণ ‘লাই ফ্ল্যাট’ স্লোগানের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, যার মানে হলো দীর্ঘ কর্মঘণ্টা পরিহার করে ন্যূনতম কাজ করা এবং বেঁচে থাকার জন্য যতটা জরুরি ততটার জন্যই চেষ্টা করা। যারা ঘরে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে পারে আর যারা পারে-না, মহামারি তাদের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর করেছে।

২০২২ সালে মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে যে কাজে ফিরে গেলে সত্যিই তাদের জীবনমানের উন্নতি হবে। সেই বিন্দুতে পৌঁছোতে হলে সরকার ও কোম্পানি উভয়কেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষা ব্যাহত হওয়ার ক্ষতি পূরণে বিনিয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮০টি দেশে ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী মহামারির কারণে স্কুল থেকে দূরে ছিল। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে তার জন্য কর্মসূচি চালু করতে হবে-এবং একুশ শতকের চাহিদামাফিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা রপ্ত করতে পারে-যা তাদের ভালো চাকরি পেতে সাহায্য করবে।

এই কাজ সরকার একা পারবে না, তবে তারা অন্তত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান ঠিক করে দিতে পারে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে তাদের কর্মীদের পেছনে আরও বিনিয়োগ করে, তার জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা কিংবা তা আরও জোরদার করা যেতে পারে। নিয়োগদাতাদের দিক থেকে কর্মস্থলকে নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার, কর্মীদের প্রতি আস্থার প্রদর্শন ঘটানো দরকার, পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং কাজের নতুন ধরনকে ধারণ করা দরকার।

বিশ্বব্যাপী ডজন ডজন দেশে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে, অথবা সরকারিভাবে ঘোষিত ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২২ সালে নাগরিকদের তরফে তাদের নেতাদের জবাবদিহি এবং প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও জনগণের আস্থা ফেরত আনার জন্য উপায় বের করতে হবে।

২০২২-এর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, কর্তৃত্ববাদমুখী বৈশ্বিক প্রবণতাকে বাধা দেওয়া। মার্কিন সংস্থা ফ্রিডম হাউসের মতে, মহামারি গরিব ও ধনী নির্বিশেষে কমপক্ষে ৮০টি দেশে সরকারি ক্ষমতা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করেছে। সরকারি নজরদারি, পুলিশি বর্বরতা এবং আটককরণ বেড়েছে। অনেক দেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে বা তা সংকুচিত হয়েছে। নাজুক জনগোষ্ঠী তথা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অভিবাসীরা মাত্রাতিরিক্ত হারে দুর্ভোগে পড়েছে।
রাজনৈতিক দুর্নীতিও বেড়েছে। ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন অনুসারে, মৌরিতানিয়ায় শাসক দলের মন্ত্রীরা কোভিড-১৯ তহবিলের অপব্যবহার করেছে। ২০২০ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রীসহ সমগ্র মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। যুক্তরাজ্যে, রক্ষণশীল দলের সদস্য ও সমর্থকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তিতে বিশেষ ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ সুবিধা দেওয়া হয়।

বিশ্বব্যাপী ডজন ডজন দেশে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে, অথবা সরকারিভাবে ঘোষিত ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২২ সালে নাগরিকদের তরফে তাদের নেতাদের জবাবদিহি এবং প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও জনগণের আস্থা ফেরত আনার জন্য উপায় বের করতে হবে। ৫টা জিনিস সরকার কতটা ভালোভাবে করে তার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে কিছু কিছু দেশে এটা ঘটছে: জনসেবা সরবরাহ কিংবা পরিচালন; পরিবর্তনে সাড়া দেওয়া এবং নাগরিকদের সুরক্ষা; সরকারি সম্পদ ও ক্ষমতার নৈতিক ব্যবহার; নাগরিকদের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং সরকারি সিদ্ধান্তগুলো তাদের কাছে ব্যাখ্যা করা; এবং সবার জন্য জীবন মানের উন্নতি ঘটানো।

২০২২-এ সালে বিশ্বের সামনে হাজির হওয়া তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো আরও একটা মহামারি। যদিও এটা বলা সহজ যে কোভিড-১৯ আমাদের জীবৎকালের আর সব জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থাকে ছাপিয়ে গিয়েছে, তাহলেও আমাদের বর্তমান মনযোগ যেন অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির হুমকি বিষয়ে অন্ধ হয়ে না থাকে। যেমন, এই ডিসেম্বরের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যের প্রধান পশু চিকিৎসা কর্মকর্তা ‘মানুষ, প্রাণী ও বাণিজ্যের জন্য ব্যাপক হুমকি সৃষ্টিকারী অভূতপূর্ব মাত্রার’ অ্যাভিয়ান ফ্লু বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন।

২০২১ সালে পৃথিবী দক্ষতা ও সমতার সঙ্গে কোভিড-১৯ এর টিকা, চিকিৎসা ও থেরাপি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সকলের জন্য সুরক্ষার স্বার্থে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের বৈশ্বিক প্রাপ্যতার (কোভ্যাক্স) সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে ভাইরাসের অভিযোজন ও বিস্তার রোধ করার কথা ছিল। কিন্তু ধনী সরকারগুলি তারপরও নিজেদের নাগরিকদের জন্য আগে টিকা সংগ্রহে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।

সরকারগুলোর মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতার বিষয়টি কোনো অসম্ভব আদর্শ নয়। এর মূল চাবিকাঠি হলো এমনভাবে আইন, প্রতিষ্ঠান ও নীতি বাস্তবায়নের নকশা প্রণয়ন, যা দেশগুলোকে আশ্বস্ত করবে যে সকলেই (বেশির ভাগ) তা মেনে চলবে। কোভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি গভীর ত্রুটি হলো এই যে, সরকারগুলি টিকার ডোজ কেনার জন্য কাকে কী পরিমাণ অর্থ দিচ্ছে সে বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব। ২০২২ সালে, দুনিয়াকে টিকা নিয়ে গবেষণা, তা বিতরণ, এবং অর্থায়নের বৈশ্বিক আয়োজনকে জরুরিভাবে পুনর্বিন্যস্ত ও উন্নত করতে হবে। আর তা করতে হবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে সম্ভব করার জন্য দরকারি ন্যূনতম আস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে।

চূড়ান্তভাবে, ২০২২ সালে কোভিড-১৯ অর্থনৈতিক বিধিমালাকে বদলে দিচ্ছে। অনেক দেশের চিকিৎসা সরঞ্জাম, চিকিৎসা দেওয়া ও টিকার কেনার অভিজ্ঞতা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করছে। সম্প্রতি ভারত ও রাশিয়া সামরিক সহযোগিতা থেকে বাণিজ্য পর্যন্ত ২৮টি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিয়েছে। ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন আত্মসচেতনভাবেই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে প্রতিরক্ষা ও সামরিক পরিকল্পনা পরিভাষা ‘মুক্ত কৌশলগত স্বাবলম্বিতা’র ধারণাকে গ্রহণ করেছে। নিরাপত্তা উদ্বেগের সঙ্গে অর্থনৈতিক লক্ষ্য মিশিয়ে নেওয়ার বেলায় তাইওয়ান এক ভালো উদাহরণ। এর সার্বভৌমত্ব এখন প্রবল আকাঙ্ক্ষিত উচ্চ-মানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে দেশটির নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে জুড়ে গেছে।
২০২২ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আরও ঘনীভূত হয়ে আসছে।

তাহলেও এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের চূড়াতেও বুনিয়াদি আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও পারস্পরিক সংযমের প্রতিষ্ঠান তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল কেবল উভয় পক্ষকে আশ্বস্ত করার মতো ধৈর্যশীল আলোচনা ও ব্যবস্থাদির কারণে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে আস্থা সৃষ্টি কোনো সর্বরোগহর ওষুধ না হলেও, এর কিছু কার্যকারিতা আছে। বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের সমর্থন এটা উত্তেজনা প্রশমনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।
কোভিড-১৯ এর আগের অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া যাবে না। কেননা এই মহামারি অনেক বেশি বিষয়কে বদলে দিয়েছে। আসন্ন বছরের চ্যালেঞ্জ হলো কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে আস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দিকে নজর রেখে বিধিব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত ও নতুনভাবে কল্পনা করা।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

এনগাইরে উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটিনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন।