আসামের রাজনীতিতে ‘আজমল হুজুর’ কেন ফ্যাক্টর

জনসভায় মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল

মাওলানা বদরুদ্দীন আজমলের দল এআইইউডিএফের (অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) ভারতীয় লোকসভায় সদস্য আছেন মাত্র একজন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির চলতি প্রচার দেখলে মনে হবে, তিনি বোধ হয় ভারতজুড়ে তাদের বড় এক প্রতিপক্ষ।

কে এই মাওলানা? কেন আজমলের ওপর এত ক্ষিপ্ত বিজেপি? কেন সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নামে প্রচারযুদ্ধ দেখা যায়? এই প্রচারযুদ্ধের মূল রাজনীতি আসলে কী? সেসব প্রশ্নের অনুসন্ধানে নামলেই মেলে কেবল ধর্মবিদ্বেষ আর নোংরা কৌশলের নিদর্শন।

যেভাবে রাজনীতিতে মাওলানা আজমল
বদরুদ্দীন আজমল মূলত ব্যবসায়ী। ৫৫ বছর বয়সে রাজনীতিতে এসেছিলেন আকস্মিকভাবে ২০০৫-এ। ব্যবসার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারের সেবামূলক অনেক কাজ ছিল এবং আছে। স্বাস্থ্যসেবা, কলেজ চালানো, নারী শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতে আসামে অনেক অর্থ ব্যয় করে এই পরিবার। বাবা আজমল আলী সুগন্ধির ব্যবসা করে বিস্তর অর্থবিত্তের মালিক হন। সেই সূত্রে বদরুদ্দীন আজমলও ধনী মানুষ। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনে দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী প্রায় ৮০ কোটি রুপির মালিক তিনি। মধ্য আসামের হোজাইয়ে তাঁদের পুরোনো ভিটা। এলাকাটিতে প্রায় ৭০ ভাগ বাংলাভাষীর বাস। এখানেই ১৯২৩-এ জন্ম বদরুদ্দীন আজমলের বাবার। সেখানে আলীনগরে পড়তেন তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে এই পরিবারের সম্পর্কের কোনো যোগসূত্রই মেলে না।

ব্যবসা ও সমাজসেবা সামলে আজমলের রাজনীতিতে আসা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণও। আসামের রাজনীতিতে মুসলমানদের বড় অংশ থাকে ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে। অর্থনৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে তারা। অথচ সংখ্যায় বিপুল। আসামের জনসংখ্যার ৩০ ভাগের বেশি মুসলমান হিস্যার প্রায় ৬৫ ভাগই চরের ‘মিয়া-মুসলমান’রা। বিজেপির সঙ্গে যুক্ত অসমীয়া রাজনীতিবিদদের একাংশ ‘মিয়া’দের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতিতেও অনাগ্রহী।

এই গরিব মুসলমানদের কাছে আগে থেকে সমাজসেবী ‘আজমল হুজুর’-এর সুনাম ছিল। রাজনীতিতে সেটা তাঁর বড় পুঁজি হিসেবে কাজ করেছে ২০০৫ থেকে। তবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তও ছিল। প্রদেশটির মুসলমানদের যে রাজনীতিবিদেরা ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে দশকের পর দশক ব্যবহার করেছেন, তাঁরা আজমলের সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেননি। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরের বছরই আজমলের ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট আসামের রাজনীতির পুরোনো ছক পাল্টে দেয়। ‘ভাসানচরের মাওলানা’র পর এভাবেই আসামে শুরু হয় দ্বিতীয় আরেক ‘মাওলানার রাজনীতি’।

‘আজমল হুজুর’ কেন শুধু মুসলমানদের নিয়ে দল করলেন না
বদরুদ্দীন আজমল দেওবন্দে আরবি ও ধর্মতত্ত্বে ফাজিল পর্যন্ত পড়েছেন। তবে দল করার সময় ভিন্ন কৌশল নেন। মুসলমানদের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া হিন্দুদেরও এক কাতারে আনার চেষ্টা করেন। আসামের মুসলমানপ্রধান অনেক এলাকা ভোটে শিডিউল কাস্ট ও শিডিউল ট্রাইবদের জন্য সংরক্ষিত। এই বিবেচনা থেকেই ‘আজমল হুজুর’ নিজ দলকে কেবল মুসলমানদের নিয়ে গড়তে চাননি। ২০০৬ সালে ইউডিএফ আসামজুড়ে যে ৭৩ জন প্রার্থী দিয়েছিল, তাতে ৩৪ জন ছিলেন অমুসলমান। কৌশল হিসেবে এটা ঠিক ছিল। কেবল নির্বাচনী বিবেচনাতেই নয়, বৃহত্তর আসামে অসমীয়া প্রভাবশালীদের বিপরীতে আসামের মুসলমান ও অমুসলমান দলিতরা আর্থসামাজিকভাবে একই জমিনে দাঁড়িয়ে। রাজনীতিতে এঁদের এক কাফেলায় না এনে ভোটের পুরোনো গণিত বদলানো কঠিন ছিল।

২০০৬-এর রাজ্য নির্বাচনে ইউডিএফ ১০টি আসন পায় ১২৬ আসনের পরিষদে। আজমল সেবার দক্ষিণ সালমারা ও যমুনামুখ-দুজায়গায় জেতেন। ২০১১ সালে এটা ১৮ পর্যন্ত হয়েছিল। সেবার তারা বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হয়ে যায়। লোকসভায় এই দলের সবচেয়ে বেশি সফলতা ২০১৬ সালে। রাজ্যের ১২টি আসনে তিনটি আসন পায় তারা ওই বছর। পরের নির্বাচনে তার দুটি খুইয়েছে। সর্বশেষ কেবল ধুবড়িতে আজমল জিতেছেন প্রায় ৪০ হাজার ভোটের ব্যবধানে।
নিজস্ব একটা ভোটব্যাংক থাকলেও একা লড়ে বিধানসভায় ১০-১৫ আসন এবং লোকসভায় ২-৩টি আসনের বেশি এই দলের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তবে এই শক্তি নিয়ে আসামে অনেক সময় তারা সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন কংগ্রেস, বিজেপি ও অসমীয়া প্রভাবিত দলের কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না।

কংগ্রেস ও বিজেপিতে যে কারণে অস্বস্তি
আজমল হুজুর যাঁদের সমর্থন পাচ্ছেন, তাঁরা সবাই অতীতে কংগ্রেসের নিরুপায় ভোটার ছিলেন। ফলে কংগ্রেসের জন্য আজমল অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছেন। তিনি প্রথম যখন লোকসভায় জেতেন, সেটা কংগ্রেসের এমপি আনোয়ার হোসেনকে হারিয়ে। যেবার দক্ষিণ সালমারায় হারেন, সেটাও কংগ্রেসের প্রার্থী ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর কাছে। এসব অভিজ্ঞতার কারণে রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আজমল হুজুরকে বিজেপির মতোই কংগ্রেসও সহ্য করতে পারত না; কটু কথা বলত। তাতে ফল হয়েছে এই—কংগ্রেসের জন্য প্রায় নিরাপদ রাজ্য আসামে বিজেপি গত নির্বাচন শেষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গড়ে। সেই শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে এবার কংগ্রেস নির্বাচনে এই ‘হুজুর’কে সঙ্গে নিয়েছে। আর বিজেপি কৌশল নিয়েছে ভিন্ন।

বদরুদ্দীন আজমলকে নিয়ে কংগ্রেসের ক্ষোভ-দুঃখ-অস্বস্তি ছিল রাজনৈতিক। সেই তুলনায় বিজেপির বিরোধিতা বেশ অরাজনৈতিক চরিত্রের। কখনো কখনো তা সরাসরি ব্যক্তি আক্রমণই হয়ে ওঠে। এবার বিজেপি খোলামেলাই বলছে, কংগ্রেস নয়, তারা আজমলকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। বিজেপির জন্য নাকি আজমলই একমাত্র ‘ফ্যাক্টর’। তবে ভোটের হিসাব একদম সেটা বলে না।

আজমলের দল জোট থেকে পাওয়া মাত্র ২০-২৫টা আসনে প্রার্থী দেবে। জিতবে হয়তো ১২ থেকে ১৫টিতে। তারপরও কেন তিনি বিজেপির জন্য এত ফ্যাক্টর হলেন?

তার কারণ লুকিয়ে আছে হুজুরের নির্বাচনী কৌশলে। এবারের নির্বাচনে প্রথম থেকে তিনি চেষ্টা করছেন বিজেপিবিরোধী একক জোট করতে। যাতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ৩০ ভাগ ভোটই বিজেপিবিরোধী শিবির পায়। সেটা সফল হয়েছে ইউডিএফের কিছু ত্যাগের বিনিময়ে। মুসলমানপ্রধান অনেক এলাকায় তাদের কিছু আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে হয়েছে। তবে একই সঙ্গে যেসব আসনে তাদের প্রার্থী থাকছেন, সেখানে কংগ্রেসের ভোটও পাবেন তাঁরা। ফলে বিজেপিবিরোধী ভোট বিভক্ত হওয়ার সুযোগ কমছে। ইউডিএফের রাজনীতি এখানেই বিজেপির জন্য বড় ক্ষতিকর হয়েছে।

বদরুদ্দীন আজমলের সঙ্গে কেবল কংগ্রেস নয়, স্থানীয় বামপন্থীদেরও জোট হয়েছে এবার। আসামে বামেরা এখন আর শক্তিশালী নয়। কিন্তু তাদের পেয়ে এই জোটের নৈতিক জোর বেড়েছে। এই জোটে আছে প্রভাবশালী এক জাতিসত্তা ‘বড়’রাও। কিছু এলাকায় তাদের ভোট অনেক। এ রকম বহু মতাদর্শের বৈচিত্র্যপূর্ণ জোটকে নিয়ে বিজেপির বেশ সমস্যা।

নির্বাচনী মাঠে এদের কোণঠাসা কায়দা হিসেবে বিজেপি মূল কৌশল নিয়েছে আজমল হুজুরকে ভারত ও আসামবিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরা।

আজমলের দীর্ঘ দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি-দেওবন্দের শিক্ষাজীবন, তাঁর মুসলমান ভোটব্যাংক সব মিলিয়ে এবং সঙ্গে কিছু অসত্য তথ্য যুক্ত করে এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যাতে আসামের পুরো ভোট হিন্দু-মুসলমান দুই ধারায় ভাগ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আজমলের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়ানো হয়েছে, যেখানে দেখানো হয় তিনি ভারতকে ‘ইসলাম রাষ্ট্র’ বানাতে চান। এভাবে তুলে ধরে তাঁকে সংখ্যাগুরুদের কাছে ভীতিকর হিসেবে দেখালে তাঁর নির্বাচনী মিত্র কংগ্রেসেরও ভোট কমতে পারে। চলতি প্রচারযুদ্ধের মূল লক্ষ্য সেটাই। আজমল আসলে এসব প্রচারে উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু ইন্ডিয়া টুডে, অল্ট-নিউজ ইত্যাদি সংস্থার ‘ফেইক নিউজ ওয়ার রুমে’র তদন্তে সাক্ষ্য মিলছে এসব ভিডিও মিথ্যা।

কেন আজমল হুজুর নোংরা প্রচারযুদ্ধের শিকার?
আসামে এবার প্রধান নির্বাচনী ইস্যু হওয়ার কথা নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। অসমীয়ারা তাদের রাজ্যে এই আইনের বাস্তবায়ন চায় না। এই আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিজেপি সরকার আসামজুড়ে কয়েক লাখ হিন্দুকে নাগরিকত্ব দিতে আগ্রহী বলে অসমীয়াদের অভিযোগ। যেহেতু আপার আসামের অসমীয়ারা এর বিরুদ্ধে এ কারণে বিজেপি চেষ্টা করছে নির্বাচনের ইস্যু পাল্টাতে। তাদের নতুন ভিলেন দরকার এখনই।

আজমল ও দরিদ্র বাংলাভাষী মিয়া-মুসলমানেরা এ রকম ভিলেন হিসেবে পুরোনো সস্তা বিকল্প। ভাষা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস মিলিয়ে আজমল ও মিয়াদের সহজেই পূর্ব বাংলার অভিবাসী মুসলমানদের ঐতিহাসিক প্রতীক হিসেবে দেখানো যায়। অথচ মাওলানা আজমল দেওবন্দ ঘরানার প্রাচীন দল জামিয়াত ‍উলেমা-ই-হিন্দের সঙ্গেও জড়িত। যাঁরা, বাংলাদেশ তো বহু পরের প্রসঙ্গ—পাকিস্তান আন্দোলনেরও বিরোধী ছিলেন। ভারত ভাগই চাননি তাঁরা।

মাওলানা আজমলকে এবার যে আগের মতো কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে, তা–ই নয়। মোগলদের প্রতিনিধি হিসেবেও দেখানো হচ্ছে তাঁকে! অর্থাৎ যতভাবে মুসলমান ভীতি তৈরি করা যায়, তার সব চেষ্টাই চলছে। এসব প্রচারের ফাঁকে হালকা করে এমন ইঙ্গিত থাকে, আজমলের জোট ক্ষমতায় এলে সীমান্ত পেরিয়ে আবার শরণার্থীদের ঢল নামবে।

ভীতি তৈরির এই রাজনীতি আসামে বহু বছরের পুরোনো এক দৃশ্য। এবার তার তীব্রতা বেড়েছে কেবল। আগের মতোই মূল জনগোষ্ঠী অসমীয়া ভোটাররা আবারও এ রকম নির্বাচনী প্রচারণাতেই বিভ্রান্ত হবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে মে মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক