
গোবিন্দগঞ্জের বাগদা এলাকাটি আমাদের দাদাবাড়ির পাশের গ্রাম। আমাদের গ্রামের বাড়িটাও বিখ্যাত ছিল আখের গুড় বানানোর জন্য। একটা আখ মাড়াইয়ের যন্ত্র দুটো গরু ঘোরাচ্ছে কলুর বলদের মতো করে। আখ ঢোকানো হচ্ছে মেশিনে, চিপে-পিষে বের করা হচ্ছে আখের রস। পাশে বড় বড় চুলায় গনগন করে জ্বলছে আগুন। বিশাল তাওয়ায় সেই রস জ্বাল হচ্ছে। একটু পরে রং লালচে হতে শুরু করল, আর আমরা কলাগাছের কাণ্ড কেটে নৌকার মতো পাত্র বানিয়ে আনলাম, ‘চ্যাংটা’ বা আঠালো তরল গুড় দেওয়া হলো তাতে, গরম-গরম। খানিকটা ঠান্ডা হলে আমরা সেই গুড় খেতে লাগলাম চেটেপুটে। বাড়ির সামনে নদী। সেই নদী পেরিয়ে খানিকটা হাঁটলেই শুরু হলো বাগদা। প্রান্তরের পর প্রান্তর আখের বা কুশারের খেত। রংপুর চিনিকলের জন্য এই আখখেত। আমরা বলতাম, মহিমাগঞ্জ চিনিকল।
আমাদের গান আছে:
যা মা তোর জামাইবাড়ি আমি যাব না
জামাই মা তোর চাকরি করে
মহিমাগঞ্জের সুগার মিলে
মাঝে মাঝে চিঠি লেখে বাড়ি আসে না।
সাঁওতালরা যেতেন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েও। তাঁরা চলতেন সার বেঁধে। সামনে থাকত একটা কুকুর। তাঁদের হাতের বল্লমে অনেক সময় বেঁধা থাকত কোনো বুনো প্রাণী। কখনো বা তাঁরা ধরে নিয়ে যেতেন খরগোশ। তাঁদের সঙ্গের কুকুরটাকে দেখলেই আমাদের বাড়ির কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শুরু করত। আর বড়রা আমাদের ভয় দেখাতেন। সাঁওতালরা আসছে। তোদের ধরিয়ে দেব। ঝোলায় পুরে নিয়ে চলে যাবে।
এইখানটাতেই যত সমস্যা। সাঁওতালরা ‘আমাদের মতো’ নন। তাঁরা অন্য রকম। কিন্তু আমরা সংখ্যাগুরু। সবাইকে আমাদের মতো হতে হবে। যাঁরা আমাদের মতো নন, তাঁদের একচুল জায়গাও আমরা দেব না, না হৃদয়ে, না বাস্তব জমিনে। অথচ ছোটবেলা থেকেই জানি, সাঁওতালদের বাড়িঘর আমাদের চেয়ে পরিষ্কার ছিল। তাঁদের নিকোনো উঠোন। তাঁদের ঘরবাড়ি ঝকঝকে-তকতকে। তারপরও আমরা ‘সভ্য’, আর তাঁরা ‘সভ্য’ নন? কারণ, আমরা সংখ্যাগুরু, ক্ষমতা আমরা দখল করে রেখেছি। আমরা কেন্দ্র, আর ওরা প্রান্ত। ব্রিটিশরা আমাদের অসভ্য ভাবত, সভ্যতা শেখানোর নাম করে ২০০ বছর গোলাম করে রেখেছিল। একইভাবে তারা আমেরিকায় কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় নির্মমভাবে হত্যা করেছে আদিবাসীদের।
বাগদা এলাকার চিনিকলের দখল করা জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার অভিযানের একটা ভিডিও আমরা দেখতে পাই ইন্টারনেটে। কুয়াশামাখা এক প্রহরে একদল পুলিশ দলা পাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অস্ত্র উঁচিয়ে, গুলি করতে করতে। তাদের প্রস্তুতি রীতিমতো যুদ্ধে যাওয়ার। তাদের সামনে সাধারণ একাধিক বাঙালি, অগ্নিসংযোগ করছে সাঁওতালদের ঘরবাড়িগুলোয়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে ঘরবাড়িগুলো, টিনের চালা বেঁকে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে। অন্ধকার চেরা আগুন। আর গুলির শব্দ। হয়তো কিছুই ছিল না ওই বাড়িঘরগুলোতে, হয়তো দুই, চার, দশ হাজার টাকার ঘরবাড়ি বিষয়–সম্পত্তি, কিন্তু একটা পরিবারের যে ও–ই সব। ওদের যে আর কিছু নেই!
আইনকানুনের নানা কথাও তো শুনছি। টেলিভিশনে ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলমের আলোচনা শুনছিলাম, তিনি জানাচ্ছিলেন, জমি অধিগ্রহণ করার ১৯৪৮ সালের আইন ১৯৮২ সালে বদলানো হয়, এখন সরকার জনস্বার্থে কোনো জমি অধিগ্রহণ করলে আগের কারণ বদলে গেলেও তা ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে এ কথাও জানালেন, আইনে আছে, বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, কোনো বাড়িঘর উচ্ছেদ করতে হলে আগে থেকে নোটিশ দিতে হবে।
আইনে যা-ই থাকুক, বাগদার সাঁওতালদের ওপর যখন হামলা হয়, তার ভিডিও থেকে স্পষ্ট, সাঁওতালদের আমরা মানুষ ভাবিনি, বাংলাদেশের নাগরিক ভাবিনি, তাঁদের ভেবেছি শুধুই ‘অবৈধ’, শুধুই বহিরাগত, শুধুই দখলকারী। তা না হলে ঘরবাড়িতে দেহ বরাবর পুলিশ এভাবে গুলি করত না। এটা কেবল ওই পুলিশের সমস্যা নয়, যাঁরা সামনে থেকে আগুন দিচ্ছিলেন, তাঁদের সমস্যা নয়, এটা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মানসিকতার সমস্যা, বাংলাদেশিদের মানসিকতার সমস্যা এবং আমাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্র আর তার পাইক-পেয়াদা, আমলা-কর্মচারীদের মানসিকতার মজ্জাগত সমস্যা।
আর আমরা, বাঙালিরা এবং বাংলাদেশিরা, আমেরিকায় ট্রাম্পের বিজয়ে মুষড়ে পড়ি। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের নিন্দা করি। বলি যে কম শিক্ষিতরা, গ্রামের পশ্চাৎপদ ভোটাররা ভোট দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। যিনি কিনা বলতে পারেন, কোনো মুসলমানকে আর আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। যিনি কিনা বলতে পারেন, হিস্পানিকেরা ধর্ষক। যিনি কিনা বলতে পারেন, মেক্সিকোর টাকায় যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা হবে।
কিন্তু আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে একজন করে ট্রাম্প বসে আছে। আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রটাকে নিন্দা করি। কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে একটা করে পাকিস্তানি ভূত আছর গেড়ে বসে আছে। আমরা এই দেশটাকে শুধু বাঙালির এবং শুধু মুসলমানের বলে ভাবি। আমাদের কাছে যাঁরা গ্রাহ্য হবেন, তাঁদের শুধু বাঙালি হলে চলবে না, মুসলমানও হতে হবে, শুধু মুসলমান হলেও চলবে না, বাঙালি হতে হবে। বিহারিরা মুসলমান, রোহিঙ্গারা মুসলমান, আমাদের মনের কোঠায় তাদের স্থান নেই। আমরা সেভাবেই কথাবার্তা বলি, আচার-আচরণ করি, আমাদের রাষ্ট্র সেই রকমই আচরণ করে, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা করি। কোমল আর স্পর্শকাতর অনুভূতি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের আছে। অন্যদের কোনো অনুভূতি নেই। তাই তাদের প্রার্থনাগৃহ কিংবা বাসগৃহ যখন-তখন আক্রান্ত হতে পারে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া যায়। তাদের ওপরে সহজেই গুলি চালানো যায়। এই রাষ্ট্র এতটাই নির্মম! গুলি করে মেরেছে তিনজন সাঁওতালকে। আর গুলিবিদ্ধ সাঁওতাল ভাইটিকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে হাতকড়া পরিয়ে।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত গিয়েছিলেন গোবিন্দগঞ্জের ঘটনাস্থলে। তাঁর বয়ানই আমাদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, বাগদা নামটাই এসেছে বাগদা সরেনের নাম থেকে। জমি যে সাঁওতালদেরই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপকেরা, স্থানীয় নেতারা নিশ্চয়ই বলবেন, তাঁরা সরকারি বেদখলি জমি পুনরুদ্ধার করতে গেছেন। দেশপ্রেমিকের কাজ করতে গেছেন। এটাই আমরা তাঁদের কাছ থেকে আশা করতে পারি। কারণ, দেশ মানে বাঙালি মুসলমানের দেশ। দেশপ্রেম মানে বাঙালি মুসলমান ছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কিংবা ধর্মগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ কিংবা গুলি করতে হাত না-কাঁপা।
আসুন, কল্পনা করি। একটা চার-পাঁচ বছরের শিশুর হয়ে তার কথা ভাবি। যে কিনা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল বাগদায়। সুগার মিলের ফার্মের জমিতে চালাঘরে। যে জমি তাদেরই বাপ-দাদার নিজস্ব জমি ছিল একদিন। মায়ের কোলের পাশে আরামে আর নিশ্চিন্ত ছিল সে। যার ঘরের বাইরে হেমন্তের সোনালি ধানে শিশির জমে আছে। হঠাৎই গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। সে দেখতে পেল, তার পাশে তার এক কাকা লুটিয়ে পড়ল গুলিতে। পড়িমরি দৌড়াতে দৌড়াতে একবার পাশ ফিরে সে দেখতে পেল, তার চালাঘরটা পুড়ে যাচ্ছে। হইচই গুলির শব্দ কান্না চিৎকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে তাদের কুকুরগুলো।
কবি শামসুর রাহমানের একটা কবিতা আছে। বন্দিশিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে। ‘হায় হতে পারতাম যদি পথের কুকুর।’ ১৯৭১ সালের ঢাকাকে ঢেকে রেখেছে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়। তারা হত্যা, ধর্ষণ, আগুন, বুলেটে ভয়ের সাম্রাজ্য গড়েছে ঢাকা শহরে। এমনি পটভূমিতে একটা পাকিস্তানি আর্মি ট্রাকের পেছনে তাড়া করছে একটা কুকুর।
কবি বলছেন, ‘হায় হতে পারতাম যদি একটা পথের কুকুর।’
আজকে একই রকমভাবে আমরা বাঙালি ও মুসলমানরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি প্রান্তিক গরিব—বাঙালি নয়, মুসলমান নয়—এই রকম মানুষের ওপরে। অথচ আমরা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি।
নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়া বন্ধই হলো না। হঠাৎ কোনো উসকানিতে জনতা ছুটতে থাকে উন্মত্ত হয়ে, উন্মত্ত জনতার সাইকোলজি নিয়ে অনেক গবেষণা আছে, অনেক দেশে পুলিশকে তা পড়তেও হয়। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিরতি দিয়ে দিয়ে হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, এটা তো উন্মত্ত জনতার কাজ নয়, এটা পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটন। এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটির
তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই! তা কী করে হয়! এর নামই কি সভ্যতা? এর নামই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
পবন দাস বাউলের কণ্ঠে একটা গান শুনলে মনটা হু হু করে ওঠে:
আমায় সাঁওতাল করেছে ভগবান গো।
আমায় মানুষ করেনি ভগবান।
আমি যদি ডাক্তার হতাম
কত লোককে ফুঁড়ে হে দিতাম
পঁচিশ টাকা ভিজিট নিতাম
বাড়ত কত মান গো।
আমায় সাঁওতাল করেছে ভগবান গো।
এই গানে বলা হচ্ছে, আমায় মানুষ করেনি ভগবান গো। আসলে তো তা নয়। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা ক্ষমতায় কায়েম থাকে, তারা নিজেদের জীবনপদ্ধতি ও মূল্যবোধকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, অন্যদের অসভ্য বা জংলি বা অমানুষ হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সঠিক কথাটা আগেই বলে গেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’
বাঙালিকে মানুষ হতে হবে। বাংলাদেশিদের মানুষ হতে হবে। আমাদের ভেতরের ট্রাম্পকে শাসন করতে হবে। আমাদের প্রকৃত সভ্য হতে হবে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে সবার করে তুলতে পারতে হবে। এই রাষ্ট্র বাঙালির, এই রাষ্ট্র অবাঙালির, এই রাষ্ট্র মুসলিমের, এই রাষ্ট্র অমুসলিমের। গরিবের নিঃস্বের ফকিরের, ছোটদের বড়দের সকলের, হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান—আমার এ দেশ সব মানুষের।
গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের ঘরবাড়ি আর নাসিরনগরের হিন্দু বাড়ির সঙ্গে আমাদের একাত্তরের বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ পুড়ে যাচ্ছে। আমাদের সভ্য মানুষের মুখোশটাও পুড়ে যাচ্ছে বটে।
আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজের চেহারার বদলে দেখতে পাই ট্রাম্পকে, পাকিস্তানকে, দেখতে পাই কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের সেই কার্টুন—জল্লাদের মুখ যেন নিজের ঘাড়ের ওপরে বসানো।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।