ইউক্রেন যুদ্ধে সফট পাওয়ারের প্রভাব

ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানছে
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানছে। ইউক্রেনের যোদ্ধারা তাঁদের দেশ বাঁচাতে প্রাণপণ লড়াই করছেন। এ পরিস্থিতিতে স্বঘোষিত বাস্তববাদীরা বলতেই পারেন, ‘সফট পাওয়ারের (মতাদর্শিক ক্ষমতা) জন্য এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটা যথেষ্ট।’ কিন্তু এটা খুব ভাসা-ভাসা বিশ্লেষণ। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা হচ্ছে সেই সামর্থ্য, যা প্রয়োগের মাধ্যমে একজন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের করে নিয়ে আসতে পারেন। একজন বুদ্ধিমান বাস্তববাদী ভালো করেই বোঝেন, কাঙ্ক্ষিত ফল তিনভাবে বের করে আনা যায়—বলপ্রয়োগ করে, অর্থ দিয়ে ও কাছে টেনে। অন্যভাবে বলা যায়, ভয় দেখানো, লোভ দেখানো এবং কাছে টানার কৌশল প্রয়োগ করে।

দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য লোভ দেখানোর চেয়ে বলপ্রয়োগ বেশি কার্যকর। আমি যদি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তোমার টাকা চুরি করতে চাই, তাহলে আমার উচিত হবে তোমাকে গুলি করার ভয় দেখানো। সে ক্ষেত্রে তুমি কী ভাবলে, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; আমি তোমার টাকাটা নিচ্ছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর আমি যদি মতাদর্শিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে চাই, তাহলে তোমাকে পটিয়ে তারপর টাকা নিতে হবে। এ পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। আবার সব সময় এটা কার্যকর হবে, তেমনটাও নয়। আমি যদি তোমাকে কাছে টানতে পারি, তবে তোমার কাছ থেকে টাকা পেতে আমাকে অনেক কম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কঠোর সামরিক ক্ষমতার চেয়ে অপেক্ষাকৃত নরম মতাদর্শিক ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে মতাদর্শিক ক্ষমতার প্রভাব পড়ে ধীরে। সরাসরি এর প্রভাব দেখাও যায় না। পক্ষান্তরে আমরা আমাদের চোখের সামনে বোমা ও বুলেটের প্রভাব দেখতে পাই। কিন্তু মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির মতো মতাদর্শিক ক্ষমতার প্রভাব কেবল দীর্ঘ মেয়াদেই দেখা যায়। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতার যে প্রভাব, সেটিকে উপেক্ষা করা কিংবা নাকচ করে দেওয়া হবে গুরুতর ভুল। বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদেরা ভালো করেই বোঝেন যে মূল্যবোধ নিজেই ক্ষমতা সৃষ্টি করে।

রাশিয়া এখন ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল করায়ত্ত করতে চায়। যুদ্ধের এ পর্যায়ে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে ফলাফলের ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে উঠবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের অন্য রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কী ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেয়, তার ওপর।

ইউক্রেন যুদ্ধ এসব শিক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে। স্বল্প মেয়াদে যুদ্ধের ক্ষেত্রে অবশ্যই সামরিক শক্তি আধিপত্য বিস্তার করছে। রাশিয়ার সেনারা উত্তরে বেলারুশ থেকে এবং দক্ষিণে ক্রিমিয়া দিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করে আক্রমণ শুরু করেন। প্রাথমিক যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনারা রাজধানী কিয়েভকে রক্ষা করেছেন এবং উত্তর দিক থেকে আসা আক্রমণকারী সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছেন। এটা ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার ভুল পদক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ।

রাশিয়া এখন ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল করায়ত্ত করতে চায়। যুদ্ধের এ পর্যায়ে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে ফলাফলের ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে উঠবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের অন্য রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কী ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেয়, তার ওপর। প্রথম দফায় বাণিজ্য ও আর্থিক খাতে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাতে ভ্লাদিমির পুতিনকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। তবে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তাতে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। এখন রাশিয়ার ওপর দ্বিতীয় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে চীনের মতো দেশগুলো রাশিয়াকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ভাবনাচিন্তা শুরু করবে।

আরও পড়ুন

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মতাদর্শিক ক্ষমতার প্রভাব এরই মধ্যে ফলতে শুরু করেছে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জার্মানিকে দ্বিতীয় নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন থেকে সরে আসার জন্য সতর্ক করে আসছিলেন। এর পেছনে মূলত দুটি যুক্তি তাঁরা দিয়েছিলেন। প্রথমত, এতে ইউরোপ রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে পাইপলাইনটি গেলে ইউক্রেন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের এ আহ্বান জার্মানি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর জনমতের ওপর সম্মান দেখিয়ে জার্মানির সরকার পাইপলাইন স্থাপন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে জার্মানিকে বলে আসছিল, তারা ন্যাটোতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি যেন সম্মান দেখায় এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশ করে। কিন্তু সে কথায় কান না দিয়ে জার্মানি নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে যাচ্ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও বেশ সফলভাবে মতাদর্শিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে দেশ থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেছেন, তাঁর গোলাবারুদ প্রয়োজন, বিদেশভ্রমণ নয়।

অন্যদিকে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত রাশিয়াকে সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে। সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে দেশটি রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে তারা ঝুঁকি নিতে চায় না। আবার চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হোক তা ভারত চায় না। কারণ, এটিকে তারা প্রধান ভূরাজনৈতিক হুমকি বলে মনে করে। জাতিসংঘে রাশিয়াকে দায়ী করে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে চীন এবং মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও ভোট দেয় দেশটি। এ ছাড়া চীন তাদের গণমাধ্যমে খুব শক্তভাবেই রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা প্রচার করছে।

তবে এসব মতাদর্শিক ক্ষমতার লড়াই দীর্ঘ মেয়াদে কী প্রভাব ফেলবে, তা অংশত চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডু মোরালস ম্যাটার বইয়ের লেখক