ইউরোপের রাশিয়া নীতি ঠিক করা দরকার

স্নায়ুযুদ্ধের পর কয়েক দশক পার হয়েছে। তারপরও ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার বৈরী সম্পর্ক রয়ে গেছে। ২০০০ এর দশকের মাঝামাঝিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ইস্যুতে ইউরোপীয়রা গভীরভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। তৎকালীন চ্যান্সেলর গেরার্ড শ্রোয়েডারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে মিলমিশ করতে চাইলেও মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব রাখার নীতিই মেনে চলছিল।

এ আমলে ইউরোপের রাজনীতিকদের মধ্যে রাশিয়া নিয়ে দুটি ইস্যুতে বিতর্ক চলছে। একটি হলো রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য নর্ড স্ট্রিম-২ নামে পাইপলাইন বসানোর পরিকল্পনা এবং আরেকটি হলো রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে পুতিন সরকারের কারাগারে পাঠানো। তবে এসব আলোচনার কারণে বহির্বিশ্বে রাশিয়ার চালানো অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতার কথা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

ইউরোপের কেউই আর এ কথা বিশ্বাস করে না, রাশিয়া উদার গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে এবং দেশটির সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়ালে তার সেই গণতন্ত্রমুখিতা বাড়বে। শুধু তাই নয়, তারা মনে করে ক্রেমলিনের উসকানিমূলক আচরণ ইউরোপের জন্য শুধু সমস্যাই সৃষ্টি করবে।

রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার এবং ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর মস্কোর ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপে কোনো বেগ পেতে হয়নি। অধিকন্তু রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাবকে দমিয়ে দিতে ইইউ সদস্যদের মধ্যকার কোনো কোনো দেশ সামরিক ব্যয় লক্ষণীয়ভাবে বাড়িয়েছে।

নর্ড স্ট্রিম ২ নামক গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও ইউরোপ তার জ্বালানি নীতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। ২০০০–এর দশকের মাঝামাঝিতে ইইউ সদস্যদেশগুলো জ্বালানির জন্য রাশিয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকত। এখন ইউরোপের জ্বালানি বাজার একটি সমন্বিত এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অবস্থায় এসেছে। রাশিয়া ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর এখন ইউক্রেনে পশ্চিম ইউরোপ থেকে পাইপলাইনে গ্যাস চলে যাচ্ছে। এভাবে পূর্ব ইউরোপে দিনকে দিন রাশিয়ানির্ভরতা কমছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি জোসেফ বোরেল সম্প্রতি মস্কো সফর করে ইইউর সঙ্গে রাশিয়ার ভুল–বোঝাবুঝিগুলোর অবসান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার দিক থেকে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। এখন পুতিনবিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির প্রতি ক্রেমলিনের বিধিবহির্ভূত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ইইউ যদি নতুন করে রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে, তাহলে পুতিনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামনে আসবে এবং সেই আলোচনার ভিড়ে বহির্বিশ্বে, বিশেষত ইউরোপে পুতিন যেসব সমস্যা তৈরি করেছেন, সেই আলোচনা হারিয়ে যাবে।

পুতিন লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং রুশ সমাজ যেভাবে তাঁর করায়ত্ত ছিল, এখন তাঁর সেই নিয়ন্ত্রণ ঢিলা হয়ে আসছে। এর ফলে রাশিয়া রাজনৈতিক ক্ষয় ও অবনমনের দিকে যাচ্ছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা অনুপাতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মূল আয় পড়তির দিকে। পুতিন তাঁর দেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্যদিকে নাভালনি সুদর্শন যুবা পুরুষ। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদ কিংবা উদার গণতন্ত্রেও বিশ্বাসী নন। তাঁর জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ক্রেমলিনকে নাভালনির সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত দিনে তাঁকেই মনে করা হচ্ছে পুতিনকে পরাস্ত করার মতো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।

এ অবস্থায় ইউরোপের কিছু নেতা রাশিয়ার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার পক্ষে মত দিচ্ছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মতো যাঁরা রাশিয়ার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করার পক্ষে, তাঁরা ক্রেমলিনের সঙ্গে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাসদার মতো পুতিনবিরোধীরা পুতিনকে নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি নন।

চীন যেখানে ধীরে ধীরে পরাশক্তি হয়ে উঠছে এবং বৈশ্বিকভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করছে, রাশিয়া ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে। এ অবস্থায় রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য তাড়াহুড়া করা কিংবা রাশিয়াকে জোর করে কূটনৈতিক সংকটে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। বরং আগামী কয়েক বছরে পুতিন রাশিয়াকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যান, তার জন্য ইইউর অপেক্ষা করা উচিত হবে। এ মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ালে কিংবা রাশিয়াকে বেকায়দায় ফেললে ইইউর কতটুকু লাভ, তা আগে ইউরোপের নেতাদের হিসাব করতে হবে।

ইউরোপ যদি নাভালনির পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে কথা বলতে থাকে, তাহলে পুতিন নাভালনিকে রুশদের কাছে বিদেশিদের এজেন্ট হিসেবে চিত্রায়িত করার সুযোগ পাবেন। এতে পুতিনের জনপ্রিয়তা বাড়বে এবং ইউরোপের বিষয়ে ক্রেমলিন নেতিবাচক ধারণা তৈরি করার সুযোগ পাবে।

এ কারণে আপাতত অপেক্ষা করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করাই ইউরোপের জন্য সুচিন্তিত কাজ হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক