ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে অকাস নিয়ে উত্তেজনা

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলগত অঞ্চলে হঠাৎ করে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন এই অঞ্চলে একটি বিশেষ কৌশলগত নিরাপত্তা চুক্তির ঘোষণা দেয়, তখন এর সূচনা ঘটে। এই চুক্তির নাম হচ্ছে অকাস (এইউকেইউএস) এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। চুক্তি অনুযায়ী এই তিন দেশের অংশীদারির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করতে যাচ্ছে। তবে এই চুক্তির অধীনে অন্যান্য বিষয়েও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার ভেতরে প্রধানত থাকছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা ইত্যাদি। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হবে যে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রথমবারের মতো সামরিক চুক্তি ঘোষিত হলো। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হিসেবে যদিও সুনির্দিষ্টভাবে চীনকে প্রতিহত করার বিষয়টি উল্লেখ করা নেই, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে একমাত্র লক্ষ্য চীনের উদীয়মান শক্তিকে বিশেষ করে তার সামরিক ও নৌশক্তিকে প্রতিহত করা।

জানা যাচ্ছে, এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে তাদের পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন প্রযুক্তি প্রদান করবে এবং তারই আওতায় অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ডকইয়ার্ডে আটটি সাবমেরিন তৈরি করা হবে। ১৯৫৮ সালে যুক্তরাজ্যকে এই প্রযুক্তি দেওয়ার পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি দেশকে এই প্রযুক্তি দিতে যাচ্ছে। এতে করে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়বে এবং এর মধ্য দিয়ে কৌশলগত এই অঞ্চলে নতুন মেরুকরণের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল একটি অতি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নৌ-অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর ভিত্তি করে যে পরাশক্তির উত্থান আমরা দেখেছিলাম, একই ধরনের পরিস্থিতি বর্তমানে এই নৌ-অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে।

অকাস চুক্তির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্স ২০১৬ সালের এক চুক্তির মাধ্যমে ১২টি জ্বালানি ইঞ্জিনচালিত সাবমেরিন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সহযোগিতা চুক্তির অধীনে বেশ কিছুদূর কাজেরও অগ্রগতি হয়েছিল। ফ্রান্স এই সাবমেরিনগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে দেবে বলে নিশ্চিত করেছিল। অকাস চুক্তি হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের এই ক্রয়াদেশ বাতিল ঘোষণা করে। তিন দেশের এই চুক্তি ঘোষণার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ফ্রান্স এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারে ছিল। এবং ফ্রান্স দাবি করেছে যে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই তাদের দেওয়া হয়নি। এ ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাদের মত, এটি একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং ফরাসি একজন মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে এটা শুধু চুক্তি ভঙ্গই নয়, এটা তাদের পিঠে ছুরিকাঘাতের সমতুল্য।

ফ্রান্স স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল, মিত্রদেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে একসঙ্গে নিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা করবে এবং কোনো নতুন কৌশলগত অবস্থানে তারা অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু ফ্রান্সকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে এবং অস্ট্রেলিয়া-ফ্রান্সের একটি আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক চুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে বানচাল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একটি নতুন কৌশলগত জোটের ঘোষণা এসেছে। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে এমনকি এটাও বলা হয়েছে যে তারা ন্যাটোর মিলিটারি কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত থাকা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করবে। অনেক বছরে ন্যাটো এবং আন্ত-আটলান্টিক সম্পর্ক এ রকম সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েন লাঘবের উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এ ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকেই যাবে।

ফ্রান্স ছাড়াও স্বাভাবিকভাবে চীনের কাছ থেকে শক্ত প্রতিক্রিয়া এসেছে। তারা মনে করছে যে এই চুক্তির ফলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে। চীন মনে করে, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। মালয়েশিয়া মনে করে, চুক্তিটির ফলে এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। আঞ্চলিক অন্যান্য দেশ এখনো প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। এটা লক্ষণীয় যে ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসিয়ানের অবস্থান, কিন্তু এই চুক্তিতে এই অঞ্চলের কোনো দেশের অন্তর্ভুক্তি বা ভূমিকা নেই। তা ছাড়া আকস গঠনের পর কোয়াডের গুরুত্ব এবং ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠে এসেছে। কোয়াডের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এর যে আলোচ্যসূচি আছে, সেগুলো মূলত সামাজিক এবং সামান্যই নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট। ফলে এখন এটা মনে করা যেতে পারে যে কোয়াডকে পাশে ফেলে মূল নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো হয়তোবা আকসের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

বর্তমানে পৃথিবীর ছয়টি দেশের কাছে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন প্রযুক্তি আছে এবং নিজেদের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অকাস চুক্তির অধীনে অস্ট্রেলিয়া আটটি আক্রমণ-শ্রেণির পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, অস্ট্রেলিয়া এই ধরনের প্রযুক্তির দিকে হঠাৎ এগিয়ে গেল। পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিনের বিশেষ কিছু সক্ষমতা থাকে। তার ভেতর প্রধানত হচ্ছে, তারা দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকতে সক্ষম এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের অপারেশনাল পরিধির ব্যাপকতা বাড়াতেও সক্ষম থাকবে। এ ধরনের সাবমেরিন অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে এবং তার নৌবাহিনী ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে তাদের নজরদারি এবং টহল বাড়াতে পারবে। তবে এসব সাবমেরিনে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে না, বরং তারা প্রচলিত অস্ত্রই বহন করবে।

পরমাণু শক্তি অর্জন করার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে উচ্চ স্তরের ইউরেনিয়াম ব্যবহার করতে হবে এবং এটা এমন স্তরের হতে হবে, যা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য উপযুক্ত। অস্ট্রেলিয়া পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ নয়। তারা এই প্রযুক্তির সক্ষমতা নিজে অর্জন করবে, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই উচ্চ স্তরের ইউরেনিয়াম দেবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রযুক্তি হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের ফলে বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয় সামনে চলে এসেছে। পরমাণু শক্তি অর্জন করার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে উচ্চ স্তরের ইউরেনিয়াম ব্যবহার করতে হবে এবং এটা এমন স্তরের হতে হবে, যা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য উপযুক্ত। অস্ট্রেলিয়া পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ নয়। তারা এই প্রযুক্তির সক্ষমতা নিজে অর্জন করবে, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই উচ্চ স্তরের ইউরেনিয়াম দেবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। যা-ই হোক না কেন, এর মাধ্যমে পারমাণবিক নন-প্রলিফারেশন চুক্তির লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না, তা বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় রয়েছে। তবে এই দৃষ্টান্ত কাজে লাগিয়ে অন্য দেশও উচ্চ স্তরের ইউরেনিয়াম তৈরির দিকে অগ্রসর হতে পারে।

অকাস চুক্তি এই অঞ্চলে শুধু যে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে তা নয়, বরং পারমাণবিক নন-প্রলিফারেশন চুক্তি ভঙ্গেরও প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আঞ্চলিক এবং উপ-আঞ্চলিক কৌশলগত সামরিক ভারসাম্য যেটা বর্তমানে বজায় আছে, সেটা বিপর্যস্ত হতে পারে এবং ভেঙে পড়তে পারে। তার কারণে এই অঞ্চলে নতুন করে সামরিক ও কৌশলগত উত্তেজনা বেড়ে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, মূলত যে দেশকে কেন্দ্র করে এই চুক্তি করা হয়েছে, তারা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ বসে থাকার নীতি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। বর্তমানে চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির যে গতি রয়েছে, তা অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে চীনের নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের যে প্রক্রিয়া বর্তমানে চালু আছে, তা আরও জোরদার হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, অস্ট্রেলিয়ার নৌ সক্ষমতা বৃদ্ধি চীনের বিরুদ্ধে কার্যকর দাওয়াই হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় যদি চীনের সামরিক শক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধির গতি ও পরিধি—দুটোই বাড়ে, তাহলে আপেক্ষিক প্রতিরোধকের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা হয়তো পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা পরিষ্কার করে অনুধাবন করতে পারেননি। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল একটি অতি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নৌ-অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর ভিত্তি করে যে পরাশক্তির উত্থান আমরা দেখেছিলাম, একই ধরনের পরিস্থিতি বর্তমানে এই নৌ-অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। যার কারণে বিশ্বের প্রায় সব শক্তিশালী রাষ্ট্র এখন এই নৌ-অঞ্চলে তাদের কৌশলগত অবস্থান বৃদ্ধি এবং শক্তি সঞ্চারের জন্য সচেষ্ট।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এই শূন্যতার ভেতরে যে ধরনের দ্রুত সামরিকীকরণ হচ্ছে, তা কোনো পর্যায়ে যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে এই অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে। ইন্দো-প্রশান্ত আঞ্চলিক সব দেশের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত যে এই ধরনের কোনো পরিণতির বিষয়টি মাথায় রেখে একটি টেকসই শান্তি স্থাপনের দিকে অগ্রসর হওয়া। এই অঞ্চলের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্থিতিশীলতা এবং শান্তি।

মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান এনডিসি, পিএসসি (অবসরপ্রাপ্ত) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট