গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও রকেট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর সিইও এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের ৪৪০০ কোটি ডলারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার কিনে নেওয়া নিয়ে আমাকে যখন লিখত বলা হলো তখন আমি উত্তেজনা বোধ করছিলাম।
আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার মাস্ককে নিয়ে লিখেছি। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘২০২১ সালের সেরা ব্যক্তি’ হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। যদিও টাইম ম্যাগাজিন মাস্কের মার্কিন কারখানায় শ্রমিকেরা নৃশংসভাবে লিঙ্গবৈষম্যবাদী ও বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয় এবং তাঁর কারখানায় স্থানীয় মহামারি বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখও করেছিল।
টাইম সাময়িকী মনে করে, ‘মঙ্গল গ্রহের দিকে দৃষ্টি রাখা চোখে পৃথিবীর সীমাহীন দুর্দশা ঠিকমতো মালুম না হওয়া স্বাভাবিক। আর এর সেই চোখে দুঃখী পৃথিবীর দিকে কাতর দৃষ্টি রাখা এক রকম রোমান্টিক ব্যাপার’। আর এটিই বছরের সেরা ব্যক্তিত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইতিমধ্যে ইলন মাস্ক এমন একটি প্রপঞ্চ হয়ে উঠেছেন যে, প্রতিনিয়ত আমাদের তাঁর সম্পর্কিত খবরাখবর শুনতে হচ্ছে।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লিজা ফেদারস্টোন ইলন মাস্কের টুইটার কেনার চুক্তির পর ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন: ‘লোকেরা এমন একজন অনাকর্ষণীয় ব্যক্তি সম্পর্কে দিন রাত আলোচনা করে চলেছে যিনি একটি অনাকর্ষণীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনেছেন এবং সবাই বলছে এই বৃহৎ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বের মনোযোগ নিজের দিকে রাখতে চান।’
তবে ইলন মাস্ক আরও একটি কারণে সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ পাচ্ছেন। সেটি হলো তিনি ‘বাক স্বাধীনতা’ ধারণার পক্ষে কথা বলছেন। বাক স্বাধীনতার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় তিনি বারবার বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুক্ত বাক গণতন্ত্রের একটি কার্যকর ভিত্তি এবং টুইটার হলো ডিজিটাল টাউন স্কয়ার যেখানে মানবতার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক হয়ে থাকে।’
গত ২৫ এপ্রিল মাস্ক টুইট করেন: ‘আমি আশা করি আমার ঘোর সমালোচকও টুইটারে থাকবেন কারণ বাক স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, টুইটার আসলে তা-ই।’
তাঁর এই কথায় মাস্ক ভক্তরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন। ফ্লোরিডা রিপাবলিকান কংগ্রেসের প্রার্থী ল্যাভার্ন স্পাইসার প্রতিক্রিয়ায় টুইট করেছেন: ‘পৃথিবীর বৃহত্তম সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির মালিক একজন আফ্রিকান আমেরিকান। এটি ঐতিহাসিক ঘটনা।’ তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লিংকনের (আমেরিকার কিংবদন্তি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন) ক্রীতদাসদের মুক্ত করার ঘটনার একুশ শতকীয় সংস্করণ হলো ইলন মাস্কের টুইটার কেনা।’
যে দেশটি বর্ণবৈষম্যের আবিষ্কারক সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া একজন ধনকুবেরের জন্য ‘আফ্রিকান আমেরিকান’ তকমা অর্জনের ঘটনা সত্যিকার অর্থেই ঐতিহাসিক। আরও ঐতিহাসিক ঘটনা হলো তথাকথিত ‘মুক্ত দেশ’-এ যে কোনো কিছুই সম্ভব। এখানে ‘গণতন্ত্রের’ অর্থ হলো, লাখো কোটি মানুষের খাবার এবং ঘুমানোর জায়গা না থাকার পরও একজন একক ব্যক্তির কাছে একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কেনার জন্য ৪৪০০ কোটি ডলার থাকতে পারে।
ট্রাম্প যেমন টুইটার দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব উপস্থিতি ঘোষণা করতেন, তেমন করে এল সালভাদরের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলেও টুইটারে দাপিয়ে বেড়ান। টুইটার কিনে নেওয়ার পর ইলন মাস্ক বাক স্বাধীনতা নিয়ে যে উদারপন্থী বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছেন নায়েব বুকেলে। তিনি ইংরেজিতে উত্সাহজনক মন্তব্য যোগ করেছেন: ‘হাহাহা গো ইলন!’ অর্থাৎ তিনি ইলন মাস্ককে গণতান্ত্রিক ধারণা নিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছেন।
কূটাভাষ হলো এই, বুকেলে হচ্ছেন সেই লোক যিনি কিনা বর্তমানে তাঁর দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ‘জরুরি অবস্থা’ জারি রেখেছেন এবং মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছেন। এপ্রিলের শুরুতে তাঁর দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রণীত একটি অতিরিক্ত আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো আন্দোলনে উসকানি দেওয়া তথ্য শেয়ার করলে তার ১৫ বছরের জেল হতে পারে। চিন্তা করুন, সেখানে কী পরিমাণে বাক স্বাধীনতা রয়েছে।
আদতে ইলন মাস্কের ৪৪০০ কোটি ডলারে কেনা টুইটারে বাক স্বাধীনতা কতটুকু থাকবে বা থাকবে না তা একটি বড় প্রশ্ন। যে ইলন মাস্ক ‘কার্যকর গণতন্ত্রের’ কথা বলছেন এবং টুইটারকে ‘ডিজিটাল টাউন স্কয়ার’ হিসাবে উল্লেখ করছেন তিনি একাই টুইটার নামক মহাবিশ্বের একেশ্বর হয়ে আছেন।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত
বেলেন ফার্নান্দেজ জ্যাকবিন ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর