ঈদ মানে বাড়ি ফেরা - সশরীরে বা মনে মনে
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে ডাকলুম,—‘মা’ ৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কণ্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো ৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম ৷
মায়ের কাছে সন্তানের ফেরার দৃশ্য। এই বর্ণনা চিরন্তন। চিরকাল বাংলাদেশের সন্তানেরা তাদের মায়ের কাছে ফিরেছে এমনিভাবে। কবি নির্মলেন্দু গুণ যে বর্ণনা দিয়েছেন ‘হুলিয়া’ কবিতায়। ফেরার টানের মতো শাশ্বত টান বুঝি আর হয় না। সবাই ফিরতে চায়। ঈদে বাংলাদেশ বাড়ি ফেরে। ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়। এবার একেবারে টানা আট দিন ছুটি। ঢাকায় লোক কই? তাই তো ঈদের আগের রাতে কোরবানির পশুর হাটে গরু-ছাগল আছে, মানুষ নেই। বিক্রেতাদের মাথায় হাত। অন্য দিকে বেশির ভাগ ক্রেতাদের মনে একটুখানি আফসোসও থাকতে পারে, শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই ভালো হতো। নাহ। নিয়ত হলো আসল। কোরবানি তো আসল ত্যাগ। নিজেকে বিলিয়ে দিতে শিক্ষা নেওয়া।
এবার ঈদের সকাল থেকে ভাদ্রের আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের মসজিদে দুটো জামাত হলো। কারণ, খোলা আকাশের নিচে জামাত হবে না। এই মেঘলা আকাশের নিচে ঢাকায় বসে মন কেমন করে।
মন ছুটে যায় কোন সুদূরের পানে। আমাদের বন্ধু সহকর্মী লেখক মশিউল আলম গত শুক্রবারে প্রথম আলোয় এক জুতা বিক্রেতার জীবনকাহিনি লিখেছেন। ওই তরুণ বিক্রেতা ঈদের আগের রাতে ভোর পর্যন্ত জুতা বিক্রি করেন। তারপর ছুটি পান। তারপর ছুটতে থাকেন গ্রামের উদ্দেশে। নামাজের সময়টায় তিনি থাকেন গাড়িতে। ঈদে যে বাড়ি যেতেই হবে। মা অপেক্ষা করে আছে না?
আর অপেক্ষা করে থাকে ধলেশ্বরী নদীর পারে, কেউ একজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাঁশি কবিতায় লিখেছেন—
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া---
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥
স্বজনেরা অপেক্ষা করে। মা, কিংবা বধূ, কিংবা বঁধু মানে বন্ধুরা। ছেলেবেলার সেই মাঠ, নদী, প্রান্তর, বটগাছ, বাজে পোড়া জামগাছ। বাঁশঝাড়, স্কুল। বন্ধুরা, তাদের সঙ্গে কত ডানপিটেপনার স্মৃতি।
মোহন রায়হানের একটা কবিতা আছে। ‘জোছনার ভেতরে বাড়ি ফিরছি কদিন’। ওই কবিতার শেষ লাইন, ‘হু হু করে ওঠে মন, এ রকম জোছনায় তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরা কোনোদিন হবে না আমার।’
আসলে আমাদের সবার মধ্যেই বোধ হয় একটা ফেরার টান থাকে। তা না হলে এত কষ্ট করে মানুষ বাড়ি ফেরে কেন। প্রবাসীরা, প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীরা, চিরকাল ভাবেন, এই তো আর কটা দিন, ছেলেপুলেগুলো কলেজে গেলেই দেশে ফিরে যাব। আগে তো ঢাকার লোকে বা কলকাতার লোকে ফরিদপুর বা বরিশালের গ্রামটাকে বলত দেশ। শহীদ কাদরী, কবি, যেমন নিউইয়র্কের হাসপাতালে বলেছেন, বাড়ি মানে তো দেশ। নিউইয়র্কেরটা তো বাসা। অবশেষে কবি শহীদ কাদরী বাড়ি ফিরেছেন। সাদা কাপড়ে দেহ মুড়ে।
সত্যি, আমরা ঢাকার বা শহরের আবাসটাকে বলি বাসা। আর গ্রামের বাড়িই হলো বাড়ি। ঈদ আমাদের বাড়ি ফেরার ডাক দেয়। তখন আমরা গাইতে পারি, দিন বাড়ি যায়, চড়ে পাখির ডানায়।
মাছরাঙার সাংবাদিক পরিমল মজুমদার ফেসবুকে একটা ভিডিও দিয়েছেন। একজন মা, তার কোলে কয়েক মাস বয়সী শিশু, তারা বসে আছেন একটা ট্রেনের দুটো বগির মাঝখানের জোড়টায়, একটা ছোট্ট লোহার দড়ির ওপরে। ট্রেন ছুটে চলেছে। পরিমল মজুমদার ভিডিওটার নাম দিয়েছেন ‘গরিবের বাড়ি ফেরা’।
তবে বাড়ি ফিরলে সবাই রাজা। মায়ের কাছে সব ছেলেই রাজপুত্র। আর মেয়েরা? মেয়েদের যে কোনটা ঘর, কোন বাড়িটা বাড়ি! আজকের ঈদের দিনেও কি মেয়েদের ছুটি আছে? যে মেয়ে বাপের বাড়ি গেছে, সে হয়তো আজকের দিনে রাজকন্যাই।
বাইরে বৃষ্টি। জানালা দিয়ে দেখছি, রাস্তায় কোরবানি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাবে, গন্ধ থাকবে না।
নামাজের আগে ইমাম সাহেব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। আর সেই কাহিনিটা শুনলাম, যা পড়েছিলাম ছোটবেলার পাঠ্যপুস্তকে, ‘শেখ সাদীর গুলিস্তাঁয় পড়িয়াছি, এক তৃষিত কুকুরের মুখে পানি দিয়া এক অতিশয় পাপিষ্ঠা মহিলা বেহেশতে প্রবেশ করিয়াছিল।’
পশুকেও ভালোবাসতে হবে। মানুষকে তো বটেই। আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীকে অবশ্যই।
যে যেখানে আছেন, ভালো থাকুন। নিরাপদে থাকুন। সবার ঈদ সুন্দর হোক। আবার নিরাপদে কর্মস্থলে ফিরে আসুন।