উগ্র স্বদেশবাদী ধর্মযুদ্ধ ডেকে আনছে মোদির ভারত

কলকাতায় মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে মাদার তেরেসার ছবির সামনে প্রার্থনারত সন্ন্যাসিনীরা
ছবি : এএফপি

পাঁচ বছর ধরে ভারতে যে রক্ষণশীল ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির জোয়ার চলছে, সেটা এবার নতুন যুগে প্রবেশ করছে। গত বড়দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার মিশনারিজ অব চ্যারিটির বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার লাইসেন্স নবায়ন স্থগিত করে। দাতব্য এই সংস্থা মাদার তেরেসার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। ২০১৬ সালে ক্যাথলিক চার্চ মাদার তেরেসাকে ‘সন্ত’ ঘোষণা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের শপথ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এখন ভারতকে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কিংবা ‘হিন্দু জাতি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিজেপি সরকার তাদের ধর্মান্ধ মতাদর্শের বাইরের যেকোনো সংগঠন বন্ধ করে দিতে চায়।

ভারতে পাস হওয়া ২০১০ সালের ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, এনজিওগুলোকে বিদেশি অর্থায়ন পেতে হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন। এ আইনের বলে নাগরিক সমাজের ওপর বড় ধরনের ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ আছে সরকারের। মোদির নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, এ ক্ষমতার প্রয়োগ করতে চায় তারা। সম্প্রতি এনজিও নিয়ে তাঁর বক্তব্যে দেশবাসী হতবাক হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এনজিও হচ্ছে আমাদের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র’। এ বক্তব্যের সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নাগরিক সমাজ ভারতের জাতীয় স্বার্থ বিকৃত, বিভক্ত ও হেরফের করে দিতে পারে।’

সরকার এখন এনজিওগুলোর দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করেছে। সেগুলোর অনেকগুলোই চলে বৈদেশিক অর্থায়ন কিংবা অনুদানে। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রিনপিসের বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়ার লাইসেন্স বাতিল করে দেন। ২০২০ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। ২০২১ সালের জুন মাসে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটসের ব্যাংক হিসাব বন্ধ করা হয়। সেক্যুলার এ সংস্থাগুলো তাদের উদার নীতি এবং মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের রোষানলে পড়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক অনুদাননির্ভর ধর্মভিত্তিক এনজিওগুলোও সরকারের বিশেষ হিংসার শিকার হচ্ছে। হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা এসব এনজিও করছে বলে মনে করে বিজেপি সরকার।

ভারত এখন ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। উন্নয়নশীল বিশ্বে কয়েক দশক ধরে গণতান্ত্রিক সফলতার নজির রাখার ক্ষেত্রে ভারতের অবদান খুব সামান্য। বৈচিত্র্যকে উদ্‌যাপন, ভিন্নতাকে আলিঙ্গন এবং যেকোনো মত ও পথকে বিকশিত করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম সুবিদিত। কিন্তু রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে মোদি সরকার বাকি বিশ্বকে বার্তা দিতে চাইছে, ভারতের অন্য যেকোনো ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

মিশনারিজ অব চ্যারিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সরকার ভারতের আগের সরকারগুলো থেকে নিজেদের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা টেনে দিল। গরিব, মুমূর্ষু ও আর্তের সেবায় মাদার তেরেসার মহতী কাজের পাশে আগের সরকারগুলো থেকেছে। মাদার তেরেসার কাজের জন্য অনেক হিন্দু তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিশনারিজ অব চ্যারিটির মহতী উদ্যোগগুলোর বদলে সংস্থাটি ধর্মান্তরকরণ করে, এমন একটি ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে।

মিশনারিজ অব চ্যারিটির ব্যাপারে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, গণমাধ্যমের এমন জিজ্ঞাসায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, সংস্থাটির নবায়ন আবেদন নিরীক্ষা করতে গিয়ে ‘কিছু গরমিল’ পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বরে মোদির রাজ্য গুজরাটে চ্যারিটির বিরুদ্ধে হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ আনে পুলিশ। কিন্তু সংস্থাটি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত কিংবা খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে বিয়ে দেওয়া হয় না।’

মোদি সরকার খোলাখুলি বলছে, দাতব্য কাজকে যদি ধর্মন্তরকরণে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালাবে। আবার সংস্থাগুলো পরিষ্কার করে জানিয়েছে, এ ধরনের কাজ তারা করছে না। সরকারের হিন্দুত্ববাদী অবস্থান এখানে পরিষ্কার। কেননা, ধারণা করা হচ্ছে যে খ্রিষ্টান ও মুসলিম সংস্থাগুলোই কেবল কঠোর নিরীক্ষার মুখে পড়ছে, কিন্তু হিন্দু দাতব্য সংস্থাগুলো খুব সহজেই বৈদেশিক অনুদান পাচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বিভিন্ন হিন্দু সংস্থা ভারতের আদিবাসীদের (যাদের ধর্মবিশ্বাস সর্বপ্রাণবাদী) প্রকাশ্যে ধর্মান্তরিত করছে। কিন্তু এ সংস্থাগুলোর কোনোটিই বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি দমনের মুখে পড়ছে না।

ধর্মান্তরকরণ বিষয়টি বৃহত্তর হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের একটি অংশ। হিন্দুত্ববাদের অনুসারীরা ভারতকে এমন একটি হিন্দু জাতি হিসেবে দেখতে চায়, যেখানে আক্রমণকারী কিংবা অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের মৌলিক চরিত্র বদলাতে না পারে। তারা বিশ্বাস করে, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার মানে হচ্ছে ভারতের ক্ষয়।

সরকারের এ কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই ভয়াবহ ফল ফলতে শুরু করেছে। বেইন অ্যান্ড কোম্পানির তথ্য অনুসারে, ২০১৬-২০২১–এর মধ্যে ভারতের এনজিওগুলোতে আন্তর্জাতিক অনুদান ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এ সময়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৩ হাজার এনজিওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, লাইসেন্স বাতিল করেছে ৪ হাজার ৮০০ এনজিওর।

ভারত এখন ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। উন্নয়নশীল বিশ্বে কয়েক দশক ধরে গণতান্ত্রিক সফলতার নজির রাখার ক্ষেত্রে ভারতের অবদান খুব সামান্য। বৈচিত্র্যকে উদ্‌যাপন, ভিন্নতাকে আলিঙ্গন এবং যেকোনো মত ও পথকে বিকশিত করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম সুবিদিত। কিন্তু রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে মোদি সরকার বাকি বিশ্বকে বার্তা দিতে চাইছে, ভারতের অন্য যেকোনো ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী